২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৫৫

বিআইএন চায় ভারত ভুটান চায় ট্রানজিট

ভুটান সরে যাওয়ায় বাংলাদেশ ও নেপালকে নিয়ে বিআইএন মোটরযান চুক্তি কার্যকর করতে চায় ভারত। ভুটানকে বাদ রেখে তিন দেশের মধ্যে যান চলাচল ব্যবস্থা কার্যকর করতে বাংলাদেশকে এ প্রস্তাব পাঠিয়েছে ভারত।
তাতে বলা হয়েছে, ভুটান আগ্রহী হলে পরে যেকোনো সময় এতে যোগ দিতে পারবে। ভারতের প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন কর্মকর্তারা।
পাশাপাশি ভারতের নেতৃত্বে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে একটি চুক্তি সইয়ের চেষ্টা চলছে। ভারত ওই চুক্তির খসড়া বাংলাদেশকে পাঠিয়ে তাতে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রস্তাব করেছে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা তাতে আগ্রহ দেখিয়ে এ মাসের প্রথম দিকে দিল্লিতে গিয়ে একটি বৈঠকেও অংশ নিয়েছেন।
আবার ভুটান বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ট্রানজিট চুক্তি সইয়ের প্রস্তাব করেছে। চুক্তির একটি খসড়া বাংলাদেশে পাঠিয়েছে তারা। বাংলাদেশও একটি খসড়া তৈরি করে রেখেছে। দুই খসড়া নিয়ে ঢাকার কর্মকর্তারা কয়েকটি আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছেন।

আগামী ৩০ নভেম্বর ঢাকায় ট্রানজিট বিষয়ে ভুটানের সঙ্গে গঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে চুক্তি সইয়ের বিষয়ে অগ্রগতি হবে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ডিসেম্বরে ঢাকায় বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির রূপরেখা চূড়ান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভুটানের পার্লামেন্ট বিবিআইএন মোটরযান চুক্তি অনুমোদন করেনি। এখন বাংলাদেশ ও নেপালকে নিয়ে এটি কার্যকর করার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। গত সেপ্টেম্বরে এ বিষয়ে দিল্লিতে বৈঠক ডেকেছিল ভারত। তবে যেহেতু বিবিআইএনের মোটরযান চুক্তিতে বলা আছে যে চার দেশের সম্মতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, তাই তিন দেশ নিয়ে এ উদ্যোগ আপাতত ফলপ্রসূ হবে না বলে মনে করছে বাংলাদেশ। এ জন্য ওই বৈঠকে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি অংশ নেননি।
তবে গত অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময় জয়েন্ট কনসালট্যান্টিং কমিশনের বৈঠকেও ভারতের পক্ষ থেকে বিআইএন কার্যকর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম মাহমুদ আলী বলেন, বৈঠকে ভুটানকে বাদ রেখেই বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল মোটরযান চুক্তি বাস্তবায়ন করতে একমত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা রাখা হবে, যাতে ভুটান আগ্রহী হলে পরে যেকোনো সময়ই যোগ দিতে পারে।

গত ২ নভেম্বর ঢাকায় ‘ইন্ডি বাংলাদেশ ২০১৭’ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বি এস ভালা বলেছেন, ভুটান বিবিআইএন মোটরযান চুক্তি অনুমোদন না করায় এটি কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ভুটানকে আপাতত বাইরে রেখে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল এ চুক্তি কার্যকর করতে পারে। এটি কার্যকর হলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগ বাড়বে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতের তরফ থেকে বাংলাদেশ ও নেপালকে নিয়ে বিআইএন কার্যকরের কথা বলা হচ্ছে। তবে বিবিআইএনের আওতায় চার দেশের মধ্যে যে চুক্তি সই হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে চার দেশের সম্মতি ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এ অবস্থায় বিআইএন কার্যকর করা হবে কি না, তা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
গত সোমবার সংসদে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিবিআইএন কার্যকর করার চেষ্টা চলছে। তিনি আশাবাদী, ভুটান শিগগিরই তাদের পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদন করাতে পারবে।
আপাতত ভুটানকে বাদ রেখে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মোটরযান চুক্তি কার্যকরের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ভুটানকে বাদ রেখে আপাতত তিন দেশের মধ্যে এটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভুটান বিবিআইএন কার্যকর করার জন্য কিছুটা সময় চেয়েছে। তারা যখন পারবে, তখনই এই তিন দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে, এমন ব্যবস্থা থাকছে।
বিআইএনের বাইরে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের একটি উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। এ জন্য চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে ভারত। সেটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে আসার পর তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত নেওয়ার পর ২৯ অক্টোবর আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভারত ওই খসড়ার ওপর ১ ও ২ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছে। বৈঠকে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা যোগ দেন।
২৯ অক্টোবরের বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বাংলাদেশ খসড়াটিকে বিবিআইএন মোটরযান চুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে বেশ কিছু পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের তরফ থেকে এসব ক্ষেত্রে সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমসটেক মোটরযান চুক্তির পক্ষে বাংলাদেশ। এ চুক্তি হলে বাংলাদেশের সঙ্গে আসিয়ানভুক্ত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তবে অনেক দেশ সম্পৃক্ত থাকায় এটি চূড়ান্ত রূপ পেতে সময় লাগবে।
বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোতে যানবাহন ও যাত্রী চলাচলের জন্য ভারতের নেতৃত্বে তৈরি করা চুক্তির খসড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, এটি নিয়ে ভারত কাজ করছে। বাংলাদেশও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী। দিল্লিতে এ বিষয়ে দেশগুলোর প্রতিনিধিদের বৈঠক হচ্ছে। এই চুক্তি হলে তা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড বিমসটেকের সদস্য।
ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিটসংক্রান্ত বৈঠক নভেম্বর : বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নৌ ও সড়ক পথে ভারতের ওপর দিয়ে নিজ দেশে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি সইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ভুটান। ২০১৪ সালে ভুটান চুক্তির একটি খসড়া বাংলাদেশকে দিয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশও ভুটানকে চুক্তির একটি খসড়া দিয়েছিল। মাঝখানে বিবিআইএন মোটরযান চুক্তি নিয়ে উভয় দেশই অগ্রসর হওয়ার কারণে দ্বিপক্ষীয় ট্রানজিট চুক্তি প্রয়োজনীয়তা হারায়। কিন্তু পরে বিবিআইএন চুক্তি অনুসমর্থন না করায় এখন ফের বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাচ্ছে ভুটান।
এর আগে ১৯৮০ সালে ভুটানের সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদি ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে এর মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানো হয়। তবে তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতা না থাকায় ওই চুক্তি কার্যকর করা যায়নি। ২০০০ সালের পর ওই চুক্তি আর নবায়নও করা হয়নি। ফলে আগের ওই চুক্তি এখন আর নেই।

ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির নামে ‘ট্রানজিট’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি মূলত একটি ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি। উভয় দেশের তৈরি করা খসড়া অনুযায়ী, ভুটানের পণ্য ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পর্যন্ত আসার পর তা সড়ক, রেল ও নৌপথে বাংলাদেশি যানবাহনের মাধ্যমে বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে রপ্তানি হবে। একইভাবে ভুটানের আমদানি করা পণ্য বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর থেকে বাংলাদেশি যানবাহনে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পৌঁছানোর পর তা ভুটান বা ভারতের যানবাহনে করে ভুটানে পৌঁছবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্রান্সশিপমেন্ট ফিসহ বিভিন্ন সেবা ফি আরোপ করবে।
বাংলাদেশের তৈরি করা খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভুটানের পণ্য আনা-নেওয়ার ওপর কোনো ধরনের শুল্ক বা চার্জ আরোপ করা হবে না। তবে প্রবেশপথে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে ভুটানকে। পণ্য বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ওই গ্যারান্টি মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। আর ভুটানের খসড়ায় বলা হয়েছে, ট্রানজিট পণ্যকে সব ধরনের শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। তবে যানবাহন ব্যবহারের ফিসহ বিভিন্ন সেবার বিপরীতে অন্যান্য খরচ আদায় করতে পারবে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে ৩০ নভেম্বর ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক রয়েছে। ডিসেম্বরে বাণিজ্যসচিব পর্যায়ে বৈঠক হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, স্থলবেষ্টিত ভুটান বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চাইলে বাংলাদেশ সে সুযোগ দিতে বাধ্য।

গত ১৪ নভেম্বর ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ট্রানজিট চুক্তি সইয়ের বিষয়ে আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে ১৫ টনের যানের জন্য প্রতি কিলোমিটারে প্রতি টনে ২.৩০৩ টাকা মাসুল ধরার কথা বলা হয়েছে। আর ১৫ টন থেকে ২৫ টন পর্যন্ত যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে প্রতি টনে ২.৫৮৪ টাকা এবং ২৫ টনের বেশি ওজনের যানবাহনের জন্য প্রতি টনের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ৫.৩৭৯ টাকা আরোপের কথা বলা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মাসুল কত নির্ধারণ করা হবে, তা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চূড়ান্ত করা হবে। ভুটান বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র। বাংলাদেশের ৯০টি পণ্যে ভুটান শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, বাংলাদেশ দিয়েছে ভুটানের মাত্র ১৮টি পণ্যে।


 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/11/25/569690