২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৫

বাড়তি আদায় করা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা

আসন্ন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফরম পূরণে এবার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি অন্তত ৩শ’ কোটি টাকা আদায় করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষা বোর্ডগুলো সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও আদায় করা হয়েছে পাঁচ গুণ পর্যন্ত অর্থ। বাড়তি অর্থ আদায়ের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। শিক্ষা বোর্ডগুলো একটি নোটিশ জারি করেই দায়িত্ব শেষ করছে।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে সারা দেশেই এমন চিত্র পাওয়া যায়। কোচিং ফি, হোস্টেল, ভবন সংস্কার, শিক্ষাসামগ্রী ক্রয়, উন্নয়ন, আপ্যায়ন, সাপ্তাহিক পরীক্ষাসহ নানা খাত সৃষ্টি করে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চালাকির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কোথাও রসিদ দেয়া হচ্ছে, কোথাও দেয়া হচ্ছে না। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নোটিশ দিয়ে, কেউ আবার নোটিশ না দিয়েই বাড়তি অর্থ আদায় করছে। এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে গড়ে ২ হাজার করে বেশি নিলেও অন্তত ৩০০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র বলছে, অর্থ আদায়ে টেস্ট পরীক্ষার ফলকে ফাঁদ হিসেবে পাতা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান টেস্টের ফল প্রকাশ না করেই কে কত বিষয়ে ফেল করেছে সেই হারে বাড়তি অর্থ আদায় করছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সদস্যদের ভূমিকা রয়েছে। ঢাকার বাইরে শিক্ষক সমিতিও ফরম পূরণের অঙ্ক নির্ধারণ করে বাড়তি অর্থ আদায়ের লাইসেন্স দিচ্ছে। এ নিয়ে যশোর ও চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে।

এই বাড়তি অর্থের সংস্থানে অভিভাবকদের চড়া সুদে ঋণ নেয়া, মায়ের গহনা এবং জমি বন্ধকের ঘটনাও ঘটেছে। সন্তানদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে অভিভাবকরা এ নিয়ে নিশ্চুপ। অভিভাবকরা বলছেন, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সব মেনে নিচ্ছি। বেশিরভাগ শিক্ষকই প্রতিহিংসাপরায়ণ। অভিযোগ করলে শিক্ষকরা পরীক্ষার্থীদের নানাভাবে শায়েস্তা করেন। তাছাড়া বাড়তি অর্থ দিলে পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের বাড়তি নজর থাকে। ব্যবহারিক

পরীক্ষার নম্বরও তাদের হাতে। অভিভাবকরা বলছেন, এভাবে বাড়তি ফি আদায় নতুন নয়। শিক্ষা বোর্ডগুলোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এইচএসসি পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শুরু না হলেও কোথাও কোথাও আগাম ফরম পূরণ বাবদ ফি আদায় চলছে। নেয়া হচ্ছে বাড়তি অর্থ। ঢাকার সেন্ট্রাল রোড এলাকার ‘আ’ আদ্যক্ষরের একটি কলেজ ১৬ হাজার টাকা করে নিচ্ছে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন একজন অভিভাবক।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘স্কুল-মাদ্রাসাগুলোকে বোর্ড নির্ধারিত ফির বাইরে অর্থ নিতে নিষেধ করা হয়েছে। টুকটাক অভিযোগ আমরাও পাচ্ছি। অভিযোগ আমলে নিয়ে ধরে ধরে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ অপরাধে গত বছর চট্টগ্রামের একটি স্কুলের পাঠদানের অনুমতি বাতিল করেছি। মাঠপর্যায়ের মনিটরিংয়ের ভিত্তিতেই তা সম্ভব হয়েছে। মনিটরিং করছি। ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অনেক ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত টেকানো যায় না। শিক্ষা আইন হচ্ছে। তখন আমরা আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারব।’ যুগান্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের কাছ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কোনো আশ্বাসও পাওয়া যায়নি। তবে ‘লিখিত অভিযোগ পেলে’ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।

কথা হয় পরীক্ষা সংক্রান্ত আন্তঃবোর্ডের উপকমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারের সঙ্গে। তিনি মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘ফরম পূরণে নির্ধারিত ফি’র বেশি নেয়া যাবে না। আদালতেরও নির্দেশনা আছে। বেশি ফি নেয়ার অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেনি। লিখিত অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নিতে পারি না। পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার ফুকুরহাটি কান্দাপাড়া মজিবর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃষক আবদুর রাজ্জাকের সন্তান এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তাকেও ফরম পূরণ বাবদ ৫ হাজার গুনতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সরকারি নিয়ম ১ হাজার ৬৮৫ টাকা নেয়ার। কিন্তু আমার মতো দিনমজুরকেও তিন গুণেরও বেশি টাকা দিতে হল।’ যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি মতিউর রহমান জানান, উপজেলায় ২৪টি স্কুলের প্রত্যেকটিতেই একই চিত্র।

ঢাকার মিরপুরে সরকারি বাঙলা স্কুলে ফরম পূরণে আদায় করেছে ৮ হাজার টাকার বেশি। এর মধ্যে বোর্ড ও কেন্দ্র ফি বাবদ ১৭০০ টাকা ব্যাংকে জমা নেয়া হয়। ডিসেম্বরের পর শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাবে না। অথচ মার্চ পর্যন্ত বেতনসহ ৩ হাজার এবং ক্লাস ও মডেল টেস্ট বাবদ ৩ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এ ছাড়া ফেয়ারওয়েলের নামে ৫০০ এবং কেন্দ্র ব্যবহারিকের নামে ৩০০ টাকা নেয়া হয়। আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ৭ হাজারের বেশি এবং মানবিক বিভাগে ৬ হাজার টাকারও বেশি অর্থ আদায় করা হয়েছে। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে নেয়া হয় ৯ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের সচিব নিজে। শিক্ষামন্ত্রীর নিজের এলাকার শিক্ষার্থীদেরও এই হাল। সিলেট ব্যুরো জানিয়েছে, গোলাপগঞ্জের রণকেলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৮৬০ থেকে ৪ হাজার টাকা নেয় হয়। বাড়তি অর্থের বিপরীতে স্কুল থেকে কোনো রসিদ দেয়নি বলে জানান অভিভাবক রহিম আহমদ। মীরগঞ্জ দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়েও একই চিত্র। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বকুল মিয়া জানান, বকেয়া বেতন এবং কোচিং ফি একসঙ্গে নেয়ায় পরিমাণ বেশি মনে হচ্ছে। উপজেলার অন্য স্কুল-মাদ্রাসার একই চিত্র বলে জানা গেছে। যুগান্তরের হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধিও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা জানিয়েছেন।

বরগুনা জেলা প্রতিনিধি জানান, জেলায় ১০৭টি হাইস্কুল ও ৯৮টি মাদ্রাসার সব কটির বিরুদ্ধেই সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ আছে। জামালপুর জেলা প্রতিনিধি জানান, বাড়তি অর্থ আদায়ের বড় হাতিয়ার অতিরিক্ত ক্লাস ও মডেল টেস্ট ফি। স্থানীয় সরিষাবাড়ী পৌর এলাকার আরডিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলছেন, এসএসসির ফরম পূরণে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ধার্য হলেও অভিভাবকরা দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা দিয়েছে। জেলার মাদারগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কোচিং ফি’র সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচের নামে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতি বড় ভূমিকা রেখেছে। রায়েরছড়া সদরাবাড়ি মডেল একাডেমির সিনিয়র শিক্ষক গোলাম মোস্তফা জানান, শিক্ষক সমিতি থেকে ৩১০০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দেয়। শিক্ষক সমিতির বাড়তি অর্থ আদায়ের লাইসেন্স দেয়ার খবর বরিশাল থেকেও পাওয়া গেছে।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, বাড়তি ফি আদায়ে বিজ্ঞানের বিষয় এবং গণিতকে হাতিয়ার করা হয়। কালীহাতি প্রতিনিধি জানান, বিভিন্ন স্কুলে টেস্টে ফেল করিয়ে ফরম পূরণে মোটা অঙ্ক আদায় করা হয়। আরএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই বিষয়ে ফেল করা এক ছাত্র জানান, তিনি ৬ হাজার টাকা দিয়ে ফরম পূরণের সুযোগ পেয়েছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, তার স্কুলে ২ হাজারের বেশি এক টাকাও নেয়া হয়নি। আর এলেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুল হক স্বীকার করেছেন, কোচিং ফিসহ ৩ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে।

কুমিল্লা ব্যুরো থেকে আবুল খায়ের জানান, ফরম পূরণের বাড়তি অর্থ জোগাতে অসচ্ছল অভিভাবকদের চড়া সুদে ঋণ নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, দরিদ্রপীড়িত অঞ্চলটিতে ২২০০ থেকে ২৯০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। যশোর ব্যুরো জানায়, বাসুদেব ছিদ্দিকীয়া দাখিল মাদ্রাসায় অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়ে গত ১৩ নভেম্বর শিক্ষকদের দু’গ্রুপে মারামারি হয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনা বাগেরহাটেও ঘটেছে। চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, ফরম পূরণকে কেন্দ্র করে হাজীগঞ্জের নাসিরকোর্ট হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা স্কুলে ব্যাপক ভাংচুর চালিয়েছে।

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/24/174285