২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৩৬

দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকিং খাত

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এটি নিয়ন্ত্রণ করছে দুর্বৃত্তরা। ব্যাংক মালিকদের মধ্যেও দুর্বৃত্ত রয়েছে, যাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকারদের কাজ করতে হয়। এ ধরনের দুর্বৃত্তদের অনৈতিক চাপে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ‘লোন টেকওভার ইন বাংলাদেশ : ইজ ইট এ হেলদি প্র্যাকটিস?’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, ‘লোন টেকওভার’ হল ঋণ হস্তান্তর। এক ব্যাংকের ঋণ অন্য ব্যাংক কিনে নিয়ে যায়। মূলত এখানে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়। অর্থাৎ একটি ব্যাংক কোনো গ্রাহককে ১০ কোটি টাকা ঋণ দিল। অন্য একটি ব্যাংক ওই গ্রাহককে ২০ কোটি টাকা ঋণসহ যাবতীয়
সুযোগ-সুবিধা দেয়ার লোভ দেখিয়ে নিজের ব্যাংকে নিয়ে যায়। এছাড়া অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে অনেক সময় এক ব্যাংকের মন্দ ঋণ অন্য ব্যাংক কিনে নেয়ার নজিরও রয়েছে।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিআইবিএমের পরিচালক অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি। বৈঠকের প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএমের ড. মোজাফফর আহমদ ও চেয়ার প্রফেসর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তরা এখন ব্যাংকিং খাতে ঢুকে পড়েছে। কেননা তাদের যখন অনেক টাকা হয়ে যায়, তখন তারা একটি ব্যাংক পেয়ে যায়।

তিনি বলেন, একটি ব্যাংকে গত তিন বছরে তিনজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যাংকটির জন্য ৯ মাস ধরে কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ২ থেকে ৪ লাখ টাকা দিলে এমডি পাওয়া যাবে, কিন্তু ব্যাংক চালানোর মতো যোগ্য লোক পাবেন না। উচ্চশিক্ষিত বৃত্ত পাওয়া যাবে, যারা গৃহবৃত্ত।
মেঘনা ব্যাংকের এমডির পদত্যাগের বিষয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মালিকদের চাপের কারণে মেঘনা ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যদ্দূর শুনেছি, মালিকদের ইচ্ছে অনুযায়ী ঋণ না দেয়ার কারণে তাকে বের হতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, নীতিমালার চেয়ে বড় বিষয় হল মানুষের উন্নয়ন করতে হবে। মানুষ ভালো হলে নীতিমালার দরকার নেই। ব্যাংকারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের কথা বললে চাকরি যাওয়ার ভয় আছে। এক্ষেত্রে আপনারা সংবাদকর্মীদের সহায়তা করতে পারেন। এভাবেই ব্যাংকিং খাতের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সোনালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শওকত ইসলাম বলেন, ঋণ হস্তান্তরের অনেক খারাপ দৃষ্টান্ত আছে। কিছু গ্রাহক ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য সরকারি ব্যাংককে টার্গেট করে। তারা বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা আর পরিশোধ করেন না। তিনি বলেন, ঋণ হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা ব্যাংক খাতের জন্য ক্ষতিকারক। এটি বন্ধ করতে হবে। যে গ্রাহকের ঋণ নেয়ার ক্ষমতা ১০ কোটি টাকা, তাকে দেয়া হচ্ছে ২০ কোটি।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঋণ হস্তান্তরের সময়ে সব বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে হস্তান্তর করতে হবে।
বৈঠকে অন্য বক্তারা বলেন, ঋণ হস্তান্তরের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। নীতিমালা না থাকায় এ খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়ছে।

সরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এ খাতের ব্যাংকগুলোর ভালো গ্রাহকদের বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি বাড়ছে। তাই গাইডলাইন ছাড়া কোনোভাবেই ঋণ হস্তান্তরের অনিয়ম বন্ধ করা যাবে না।

গোলটেবিল বৈঠকে ঋণ হস্তান্তরের ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল মোস্তফা। চার সদস্যের গবেষক দলে আরও ছিলেন বিআইবিএমের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. মহব্বত হোসেন, বিআইবিএমের প্রভাষক তোফায়েল আহমেদ ও রাহাত বানু।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের গ্রাহকের ঋণ ক্রয় বা টেকওভার (ঋণ হস্তান্তর) করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকার ঋণ হস্তান্তরের ঘটনা ঘটছে। এটি কেন্দ্র করে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। অনেকাংশে গ্রাহকের সব ধরনের তথ্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়া হচ্ছে, যা পরে খেলাপি হয়ে পড়ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬০ শতাংশ ব্যাংকার জানিয়েছেন, পরিচালনা পর্ষদের অযৌক্তিক চাপে ঋণ হস্তান্তরে ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। ৫ শতাংশ ব্যাংকার জানিয়েছেন, ঋণ হস্তান্তরের অদক্ষতা রয়েছে। এক শতাংশ ব্যাংকার জানিয়েছেন, ঋণ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়া হয়। ৯০ শতাংশ ব্যাংকারের মতে, হস্তান্তরিত ঋণ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি তৈরি করবে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/24/174283