২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৩৫

প্রকল্প পরামর্শকের ভুলের মাশুল ৩০০ কোটি টাকা

হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত; তিন বছর পেছাল প্রকল্প বাস্তবায়ন; ভূমি অধিগ্রহণ ক্ষতিপূরণে হয়রানি

পরামর্শক করেছে ভুল। তার মাশুল দিচ্ছে রাষ্ট্র ও দেশের জনগণ। প্রকল্প পরামর্শকের ভুলের কারণে ব্যয় বেড়েছে ৩০০ কোটি টাকা। আর প্রকল্প পিছিয়ে গেল তিন বছর। প্রকল্পটি হলো বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈশ^রদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেল লাইন নির্মাণ। ২০১৫ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পে অনেক ক্ষেত্রে ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে বিলম্ব ও হয়রানি করা হয়েছে। সম্প্রতি এমন তথ্য প্রকাশ পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে।

জানা গেছে, ঈশ^রদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ৯৮২ কোটি ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয় ২০১০ সালের অক্টোবরে। তিন বছর পর প্রকল্পের ব্যয় আবারো বাড়ানো হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৬ কোটি দুই লাখ ৬৭ হাজার টাকা। বাড়ানো হয় দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদও।
আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের সার্ভে, ডিজাইন, ড্রইং, স্পেসিফিকেশন, টেন্ডার ডকুমেন্টস ইত্যাদি তৈরির জন্য দরপত্রের মাধ্যমে যৌথভাবে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল এসিই কনসালট্যান্ট লিমিটেড আরভি অ্যাসোসিয়েট আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ার্স, পাথমার্ক অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড বাংলাদেশ এবং কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড ভারত ও এসএমএফসি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু তারা রুট অ্যালাইনমেন্ট যথাযথভাবে সার্ভে না করায় প্রকল্পের রেল ট্র্যাকের দূরত্ব ১৪ থেকে ১৫ কিলোমিটার বৃদ্ধি পায়, যার কারণে প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বেড়েছে। এই সাথে শত শত বিঘা আবাদি কৃষি জমিসহ হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগকৃত পরামর্শক প্রকল্পের ডিজাইন ড্রইং দাখিলের সময় ডুয়েলগেজ রেল ট্র্যাকের কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। ফলে প্রকল্পের সামগ্রিক কাজ তিন বছরের বেশি সময় পিছিয়ে গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় ঈশ^রদী থেকে পাবনা অংশে মাঝগ্রাম স্টেশন থেকে পাবনা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণ কাজের সময়সীমা চুক্তিপত্র অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ মে তারিখ পর্যন্ত ছিল। কয়েকবার সময়সীমা বাড়ানোর পরও আজ পর্যন্ত এ কাজ সমাপ্ত হয়নি। এমনকি ওই কাজের ২৫ কিলোমিটার ট্রাকের ব্যালাস্ট সরবরাহ কাজও অসম্পূর্ণ রয়েছে। এ ছাড়া ট্যাম্পিং মেশিন দ্বারা ট্রাক প্যাকিংকাজ এখনো শুরু করা হয়নি। মূল প্রকল্প প্রণয়নের সময় মাঝগ্রাম রেল স্টেশনে ডুয়েলগেজের সংস্থান রাখা হয়নি। পরে বিলম্বে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ বিষয়টি যুক্ত করা হয়।

এ দিকে রেল রোডের উভয় পাশের সড়ক বা মহাসড়ক ন্যূনতম ৫০ ফুট একই লেভেলে থাকার কথা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকালে রেল লেভেল ও সড়ক লেভেলের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণতা ঠিক করা হয়নি।
জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ১৯৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। পরে সংশোধিত ডিপিপিতে ব্যয় বৃদ্ধি করে ৮৩৯ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ৪৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা ধরা হয়। গত মে পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৪৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকার পুরোটাই। তবে এখানে অভিযোগ রয়েছে, এ অধিগ্রহণের সময় অনেক ভূমির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে বিলম্ব ও হয়রানি করা হয়েছে।

জানা গেছে, ঈশ^রদী-পাবনার ২৫ কিলোমিটার ট্র্যাকের নির্মাণ চুক্তিমূল্য ছিল ১৫৫ কোটি ৭৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা, যা পরে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৬ কোটি ৫০ হাজার টাকা হয়। এ অংশের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হলো মেসার্স ম্যাকস অটোমোবাইল প্রডাক্টট লিমিটেড। এ কাজ ২০১৪ সালের এপ্রিলে বা ১৮ মাসে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের তিন বছর পার হওয়ার পরও ট্র্যাক নির্মাণকাজ হয়েছে প্রায় ৯৫ শতাংশ বলে আইএমইডি বলছে। এ অংশের ফিটিংসহ আনুষঙ্গিক অনেক কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে। ব্যালাস্ট সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় এখন পর্যন্ত ট্যাম্পিং মেশিন দ্বারা নবনির্মিত ট্র্যাক দুই ধাপে প্যাকিং কাজ শূরুই করা হয়নি।
হিসেব করলে দেখা যায়, পাবনা-ঢালারচর অংশে প্রতি কিলোমিটার ট্র্যাক নির্মাণ ব্যয় হচ্ছে ১০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অথচ অন্য অংশের ব্যয় হবে সাত কোটি চার লাখ টাকা। এখানে তিন বছর দেরিতে দরপত্র করার কারণে সরকারকে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ঈশ^রদী থেকে পাবনা ট্র্যাকের চেয়ে তিন কোটি ৩৫ লাখ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে ঘাস লাগানো দরকার সেখানে তা করা হয়নি। এখানে অনেক কাজই অসম্পূর্ণ। অথচ প্রকল্পটি সময় বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইএমইডি তাদের সুপারিশে বলছে, বর্তমান অ্যালাইনমেন্ট ঈশ^রদী-মাঝগ্রাম-পাবনা-তাঁতীবান্ধা-কাশীনাথপুর-ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এর পরিবর্তে ঈশ^রদী থেকে মাঝগ্রাম-পাবনা-তাঁতীবান্ধা-ঢালারচর পর্যন্ত দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। এটি করা হলে ১৪ কিলোমিটার দূরত্ব করে যেত। অন্য দিকে পাবনা-ঢাকা সরাসরি ট্রেন পরিচালনার জন্য এ প্রকল্পে সৃষ্ট স্থায়ী অপারেশনাল সমস্যার কারণে ঢাকা-পাবনা বা পাবনা-ঢাকা ট্রেন পরিচালনার জন্য প্রতিবার ৩০ থেকে ৪০ মিনিট অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হতো। তা পরিহার করার জন্য মাঝগ্রাম রেল স্টেশন থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতু অভিমুখী রেল সংযোগ বা বাইপাস রেল নির্মাণ করা যেতে পারে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/271047