২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৩০

এ যেন গুমের জাহিলিয়াত যুগ!

সৈয়দ আবদাল আহমদ

বাংলাদেশে নাগরিকদের গুম করে ফেলার এক নিষ্ঠুর সংস্কৃতি চালু হয়েছে। গুমের এই বিভীষিকা কয়েক বছর ধরেই চলছে। এটা আরবের সেই জাহিলিয়াত যুগের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। নতুন কায়দায় আমরা যেন সেই যুগে ফিরে যাচ্ছি!

আরবের সেই জাহিলিয়াত যুগের কথা কে না জানে? ওই সময় অনেক কুপ্রথার একটি ছিল কন্যাশিশুকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা। আর এই নির্দয় কাজটি করত জন্মদাতা পিতা স্বয়ং। মায়ের অগোচরে কিংবা মাকে দেব-দেবীর ভয় দেখিয়ে তার কোলের শিশুকন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতো। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা: ইসলামকে বিজয়ী করার মাধ্যমে সেই অন্ধকার যুগের অবসান ঘটান। এই কুপ্রথা ও নিষ্ঠুরতা থেকে তিনি মানুষকে আলোর পথে নিয়ে আসেন। তাদের জাহিলিয়াতের অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত করেন। সমাজে নারীর মর্যাদা প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন।

কিন্তু মহানবী সা:-এর শিক্ষা আমরা ভুলতে বসেছি। কন্যাশিশুকে জীবন্ত হত্যার মতোই এমন নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আবার সমাজকে গ্রাস করছে। প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো নিষ্ঠুর ঘটনাই দেশে অহরহ ঘটছে, যা জাহিলি যুগের ঘটনার সাথে তুলনীয়।
বাংলাদেশে গুম এখন এক আতঙ্কের নাম। গুমের ঘটনা এতটাই বাড়ছে যে, অনায়াসেই বলা যায় দেশ গুমরাজ্যে পরিণত হয়েছে কিংবা এখন দেশে জাহিলি বা বর্বর যুগ চলছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থই এর কারণ। পরিণতিতে সমাজে ভীতি ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি একই দেশে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এটা কোনো সভ্য নাগরিকের কাম্য হতে পারে না।

হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এইচআরসি) এবং দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক রিপোর্ট উদ্ধৃত করে প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৯৫ জনকে নিখোঁজ বা গুম করা হয়েছে। গুমের পর তাদের মধ্য থেকে ৫২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ফিরে এসেছেন ১৯৫ জন। এখনো কোনো হদিস নেই ১৪৮ জনের। গুমের পর নির্যাতন ভোগ করে যারা ফিরে এসেছেন তারা চুপ হয়ে গেছেন। কারা গুম করেছিল, কেন গুম করা হয়েছিল, গুম করে কোথায় তাদের রাখা হয়েছিল সে ব্যাপারে ভয়ে তারা টুঁ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারছেন না।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে দেশে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজের সংখ্যা আরো বেশি। গুম হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনের অভিযোগ, এর সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই জড়িত। এর মধ্যে টাকার জন্যও মানুষ গুম ও খুনের শিকার হচ্ছে। প্রথম আলোর রিপোর্টটিতে আরো বলা হয়, গত তিন মাসে ঢাকা থেকেই নিখোঁজ হয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, পুস্তক প্রকাশক তানভীর ইয়াসিন করিম, সাংবাদিক উৎপল দাস, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীম আহমেদ এবং সর্বশেষ ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায় উল্লেখযোগ্য।
নিখোঁজ হওয়া ৩৯৫ জনের নাম অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস কমিশনের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের কেউ বাসা থেকে বা অফিস থেকে বেরিয়েছিলেন। কেউ বাসাতেই স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মায়ের সাথে ছিলেন। কখনো সাদা পোশাকে, কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাদের তুলে নিয়ে যায়।

এই যে এত গুম, এত খুন এবং লাশ পাওয়ার ঘটনা ঘটছে, রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে নির্বিকার, সরকার চুপ। নাগরিকদের ওপর এই নিষ্ঠুরতার ব্যাপারে রাষ্ট্রের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর ছিলÑ স্বাধীন কমিশন গঠন করে গুমের ঘটনা খতিয়ে দেখার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো অনুরোধ তিনি পাননি। অর্থাৎ এই যে গুম হচ্ছে, এটা যেন স্বাভাবিক ঘটনা। এটা আবার দেখার কী আছে? অভিযোগ বা অনুরোধ পেলেই কেবল বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়ে তার উত্তর ছিলÑ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি কাউকে গ্রেফতার করে তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে উপস্থাপন করে। অথচ গত আট-নয় বছরে যেসব ব্যক্তি গুম হয়েছেন তাদের মধ্যে দেখা গেছে, একটা বড় অংশই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে ঢাকা থেকে গুম হয়েছেন বিএনপির ২৫ জন নেতাকর্মী। বিএনপি এদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করেছে। তেমনি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাবি গুম হওয়া তাদের নেতাকর্মীর সংখ্যা ২৯ জন। তাহলে এ থেকে কী বোঝা যায়?

সরকারের পক্ষ থেকে মানুষ গুম হওয়ার কথা শুরু থেকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে এসেছে গুম বলে কিছু নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটেও উল্লেখ করা হয়েছে চলতি বছরে ৫২ জন গুম হয়েছেন। এটাও কি তাহলে মিথ্যা? আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা সঠিকভাবেই বলেছেন, অব্যাহতভাবে ঘটে চলা গুমের ঘটনা এই বার্তাই দিচ্ছে যে, দেশে আইনের শাসন বা সুশাসন বলে কিছু নেই। যে কেউ যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো জায়গা থেকে গুম হয়ে যেতে পারেন। কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি!
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম হওয়ার আগে বিএনপির মহানগর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম গুম হন। ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা থেকে গুম হন সিলেটের ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমেদ ও জুনেদ আহমেদ। সাদা পোশাকে একদল লোক তাদের তুলে নিয়ে যায়। ২০১৩ সালে দেশে ৫৩ জন গুমের শিকার হন। ৫ জানুয়ারির বিনা ভোটের নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বরের পর থেকে ২৪ দিনে গুম হন বিএনপির ১৯ জন নেতাকর্মী। পরে পাঁচজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়। ২০১৪ সালে গুম হন ৩৯ জন। এর মধ্যে ১০ জনের লাশ পাওয়া যায়। ২০১৫ সালে গুম হন ২১ জন। এর মধ্যে পাঁচজনের লাশ পাওয়া যায়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১১৩ জন গুম হন। এর মধ্যে গুপ্তহত্যার শিকার হন ১৭ জন। জীবিত উদ্ধার হন ৪৬ জন। বাকি ৫০ জনের কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ গুম হওয়ার বেশ কিছু দিন পর তাকে ভারতের শিলংয়ে উদ্ধার করা হয়। কে বা কারা তাকে সেখানে রেখে আসে। তিনি প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় ছিলেন। বর্তমানে ভারতে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশের একটি মামলা মোকাবেলা করছেন।

বিএনপির তরুণ প্রজন্মের নেতা ইলিয়াস আলী, আশুলিয়ার শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম এবং বিএনপি মহানগর নেতা ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের গুমের ঘটনা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন ঢাকা সফরকালে বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার আমিনুল ইসলাম ও ইলিয়াস আলীর গুমের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। গুমের পর নিহত আশুলিয়ার শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের। তাদের ভাগ্যে যে কী ঘটেছে কেউ তা জানে না। ২০১২ সালের ১৭ জুন গুম হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী। গত ১৭ জুন তার গুম হওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়। স্ত্রী তাহমিনা রুশদী এবং ছেলেমেয়েরা এখনো তার পথ চেয়ে আছেন। কিন্তু তারা জানেন না ইলিয়াস আলী আর কোনো দিন তাদের কাছে ফিরে আসবেন কিনা। ইলিয়াস নিখোঁজের ঘটনায় তার স্ত্রীও সালাহউদ্দিনের স্ত্রীর মতো আদালতে রিট করেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

২০১০ সালের জুন মাসে সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম হন চৌধুরী আলম। গত জুন মাসে তার গুম হওয়ার সাত বছর পূর্ণ হয়। তার পরিবারও জানে না তিনি বেঁচে আছেন না লাশ হয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে ইলিয়াস আলী গুম হওয়া পর্যন্ত ১২২ জন গুমের শিকার হন।

বাংলাদেশে যতগুলো গুমের ঘটনা ঘেটেছে, তার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযোগ পাওয়া গেছে সাদা পোশাকধারীরাই নিখোঁজ ব্যক্তিদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী এবং সর্বশেষ যারা গুম হন সব ক্ষেত্রেই একই ধরনের বর্ণনা পাওয়া গেছে। চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলীর গাড়িকে পেছনে থেকে ধাক্কা দিয়ে থামিয়ে সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। চৌধুরী আলমের ড্রাইভার জীবিত ফিরে এসে বর্ণনা দিতে পারলেও ইলিয়াসের ড্্রাইভার আনসার সেই বর্ণনাও দিতে পারেননি। তাকেও গুম হতে হয়। সালাহউদ্দিন আহমেদকেও সাদা পোশাকের ব্যক্তিরা সাদা মাইক্রোবাস করে নিয়ে যায়। তার সাথে নিয়ে যায় তার দুই কাজের লোককেও। এভাবে সাদা পোশাক ও সাদা গাড়ির অপহরণকারীরা দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে বলেছেন, গুমকে এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়াটা রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ হয়েছে। রাষ্ট্র যখন তার নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তার প্রতি নাগরিকের একটা অনাস্থা তৈরি হয়, সে রাষ্ট্রের প্রতি তার বিদ্বেষ বাড়ে। এর ফল ভয়াবহ হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের মতে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেসব দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় গুমের ঘটনা ঘটছে, সেসব দেশে আদালত সবসময় ভুক্তভোগীদের পক্ষে সুবিচার করতে পারেন না। এতে করে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়। দেশগুলোতে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। তাদের বক্তব্য থেকে এটাই বলা যায় যে, এ ধরনের প্রবণতা কারো জন্য অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি বিশেষের জন্যই শুধু ক্ষতির কারণ হয় না, রাষ্ট্রকেও ক্ষতির সম্মুখীন করে। রাষ্ট্রের অবস্থান ভেতর থেকে নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনেই গুমের মতো ঘটনাগুলোর অবসান হওয়া প্রয়োজন। এটা বন্ধ করতে না পারলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। জাতীয় স্বার্থেই গুমের সংস্কৃতির অবসান প্রয়োজন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস কাব

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/270966