২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:২৯

রবার্ট মুগাবে : মুক্তিযোদ্ধা থেকে স্বৈরাচার

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : একজন স্বাধীনতাকামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা থেকে স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হয়েছিলেন জিম্বাবুয়ান প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। ধারণা করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবেই একদিন তার জীবনাবসান ঘটবে। বয়সও হয়েছিল শতকের খুব কাছাকাছি। তাই তাকে ভাবতে হয়েছিল তার উত্তরসূরী নিয়ে। একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে নাকী একজন নারীর অবদান থাকে। মুগাবের উত্থানে নয়, বরং পতনের পেছনে অবদান আছে এক নারীর। তিনি আর কেউ নন গ্রেস মুগাবে, রবার্ট মুগাবের দ্বিতীয় স্ত্রী। জিম্বাবুয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এমারসন মেনানগাগওয়া। মুগাবের পরে তারই রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ পদে বসার কথা। কিন্তু ক্ষমতালোভী মুগাবে তাকে সরিয়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের স্ত্রী গ্রেস মুগাবের নাম ঘোষণা করেন। আর এমন উচ্চাভিলাষী ঘোষণায় রবার্ট মুগাবের পতন ডেকে আনে।
মূলত তিনি ছিলেন স্বাধীনতাকামী এক যোদ্ধা। ছিলেন নিজ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। গণতন্ত্রকামী কর্মীদের আশা ভরসার সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল। তাকে কেন্দ্র করেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহনের স্বপ্ন দেখতো অজ¯্র মানুষ; তিনি নিজেও আশা দেখিয়েছিলেন সবাইকে। শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে স্বজাতীকে রক্ষায় আন্দোলনে তিনি ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক। ফলে দীর্ঘ পরিসরে খেটেছেন জেল। অত্যাচার-নির্যাতনও তার ওপর কম হয়নি। অথচ এই মুক্তি পাগল নিপীড়িত মানুষটিই ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পাল্টে ফেললেন নিজের রূপ, বের করে আনলেন ভেতরের স্বৈরাচারী সত্ত্বাকে! তার নাম রবার্ট মুগাবে, আফ্রিকান দেশ জিম্বাবুয়ের সদ্য পদত্যাগী প্রেসিডেন্টের তিনি। রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু যিনি দখল করে রেখেছিলেন প্রায় তিন যুগেরও বেশী সময় ধরে। এরমধ্যে রাষ্ট্রপতির পদেই ছিলেন ত্রিশ বছর! যা ইতিহাসের এক উল্লেখ্যযোগ্য অধ্যায়।
তিনি তার শাসনামালে অনেক কিছুই করেছেন। কিন্তু তার নেতিবাচক দিকটাই ছিল বহুল আলোচিত। তিনি অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি স্বাবলম্বী জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছেন, স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েছেন দেশজুড়ে, জিম্বাবুয়েকে পরিণত করেছেন মগের মুলুকে। শ্বেতাঙ্গদের ওপর তার জমাট বাধা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বারবার। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদ, সেটা যাই হোক না কেন, ক্রিকেট বোর্ড থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন অধিদপ্তর থেকেও শ্বেতাঙ্গদের বের করে দিয়েছেন তিনি। দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে তার সময়েই। গণমানুষের নেতা হয়ে যিনি রাজনীতির অঙ্গনে এসেছিলেন, সেই তিনিই কিনা পরে পরিণত হয়েছেন জনবিচ্ছিন্ন স্বৈরশাসক ও একনায়কে!
তার শুরুটা মোটেও এরকম ছিল না। দরিদ্র এক ছুতারের ঘরে জন্মেছিলেন তিনি। সেই সময়টায় আফ্রিকা ছিল শ্বেতাঙ্গদের শাসনে, বিদেশী উপনিবেশ স্থাপনকারীরা ইচ্ছেমতো লুটে নিয়েছে এই বিশাল মহাদেশটাকে। ছোটবেলা থেকেই মুগাবে ছিলেন একটু অন্যরকম, সমবয়েসী ছেলেদের মতো চঞ্চল ছিলেন না, ভেড়ার পাল নিয়ে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ানোটাও পছন্দের ছিল না একদম। ভালোবাসতেন বই পড়তে, পড়ার নেশাটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। ফোর্ট হেয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর আরও বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। এরপর যোগ দেন শিক্ষকতার পেশায়।

রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন রবার্ট মুগাবে। যোগ দেন রোডেশিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে আন্দোলনরত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে। পার্টির প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান ১৯৬০ সালে। এর বছর দুয়েক পর মুগাবেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন তার রাজনৈতিক দলটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এবার নিজেই রাজনৈতিক দল গঠন করলেন মুগাবে। নাম দিলেন জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন বা সংক্ষেপে ‘জানু’। ১৯৬৪ সালে আবারও রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হন মুগাবে। জেল খাটতে হয় দশ বছর। ১৯৭৪ সালে জেল ভেঙে পালিয়ে মোজাম্বিকে পাড়ি জমান তিনি, সেখান থেকে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকলেন। রোডেশিয়ান বুশ ওয়ার নামের জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতার এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশের মানুষের মনে বীরের আসনে অধিষ্ঠিত হন মুগাবে। তারই ফলাফলস্বরূপ ১৯৮০ সালে কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থীরা জিম্বাবুয়ের নির্বাচনে দাপুটে জয় পায়। মুগাবে নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
আট বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী আট বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার কথা ছিল তার। মুগাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই সময়ের মধ্যে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু করবেন তিনি। কিন্তু কথার সঙ্গে কাজের প্রতিফলন দেখা যায়নি। গণতন্ত্রের প্রতি তার আগ্রহই ছিল না, যেটার প্রমাণ মিলেছে তার পরবর্তী কর্মকান্ডে।

১৯৮৮ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে জিম্বাবুয়ের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসেন। পেছন থেকে তাকে সমর্থন যোগাচ্ছিল দেশটির সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বেশীরভাগই ছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে মুগাবের সহযোদ্ধা। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সমর্থন ছিল মুগাবের প্রতি। রাষ্ট্রপতি হবার পরেই মুগাবে তার আসল চেহারাটা দেখানো শুরু করেছিলেন দেশের মানুষকে। শ্বেতাঙ্গদের হাতে নির্যাতিত জিম্বাবুয়ের মানুষ দেখলো, তাদেরই মতো চেহারার কালো একজন লোক বসে আছে ক্ষমতায়, কিন্ত যে স্বাধীনতার জন্যে তারা লড়েছিল, সেটার ছিটেফোঁটাও নেই দেশে! দেশজুড়ে চলতে লাগলো লুটতরাজ, শ্বেতাঙ্গদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, র্যা ঞ্চ হাউজ, ফার্ম জ্বালিয়ে দেয়া হতে লাগলো। এমনকি ক্রিকেটবোর্ড থেকে শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়-কর্তাদেরও বের করে দেয়া হলো! সরকারের সমালোচনা করে অনেকেই গুম হয়ে গেছেন। তাদের আর খুঁজেও পাওয়া যায়নি কখনও। দেশজুড়ে অভাব, মুদ্রাস্ফীতি চরমে, অথচ সেসব দিকে কোন নজরই নেই সরকারের! কয়েক বছর পর পর লোকদেখানো একটা নির্বাচনের আয়োজন করা হতো, সেটাতেও কারচুপি করে জিততো মুগাবের ‘জানু’ পার্টি। এমনকি বিদেশী পর্যবেক্ষদেরও জিম্বাবুয়েতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হতো নির্বাচনের সময়টায়!
মূলত জিম্বাবুয়ের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক কালে দুর্যোগের ঘনঘটা শুরু হয় স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে। এর আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মেনানগাগওয় কে অব্যহতি দেয়া হয়। মূলত এমারসন নিজেও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন সরাসরি। সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে এখনও গেরিলা যোদ্ধাদের প্রাধান্য বেশী, তাদের প্রায় সবই এমারসনের প্রতি সহানুভূতিশীল। কাজেই মুগাবের এমন স্বৈরাচারী আচরণ মেনে নিতে পারেনি সেনাবাহিনী, দেরীতে হলেও ঘুম ভেঙেছে তাদের। মুগাবের এই সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান, বলেছিলেন, এ ধরণের অন্যায় মেনে নেবে না তারা। তার জবাবে সেনাপ্রধানকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলেছিলেন মুগাবে। প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্যের একদিন পরেই গৃহবন্দী করা হয় মুগাবেকে। এদিকে মুগাবের রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ পার্টি দল থেকে বরখাস্ত করেছে মুগাবেকে। সেই জায়গায় পার্টি প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে পদচ্যুত ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মেনানগাগওয়াকে।

জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে মুগাবের তিনযুগের দীর্ঘ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে গত ২১ নবেম্বর। পরিসমাপ্তি ঘটেছে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়ের। তবে রবার্ট মুগাবে থাকবেন মানুষের মনে। হয়তো অত্যাচারী বা ক্ষমতালিপ্সু একজন শাসক হিসেবে। কেউ কেউ তাকে মনে রাখবেন স্বাধীনতাকামী হিসেবেও। কিন্তু এই মানুষটার ক্ষমতা ছিল জিম্বাবুয়েকে আধুনিক এবং উন্নত একটা রাষ্ট্রে পরিণত করার। কিন্তু ব্যক্তিগত লিপ্সা চরিতার্থ করতে গিয়ে সেটা তিনি করতে পারেননি। রবার্ট মুগাবে তাই ব্যর্থ একজন শাসক হিসেবেই বেঁচে থাকবেন জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে।
সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম থেকে বহুকাল দূরে ছিল আফ্রিকার দেশ জিম্বাবোয়ে। গত ৩৭ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের নেতৃত্বে দেশটির চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা অবশ্য বহুকাল ধরেই পরিচিত। এবার অস্পষ্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে আবার বিশ্বের নজর কাড়ছে দেশটি। কিন্তু সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা শুধু প্রেসিডেন্টের আশেপাশে ‘অপরাধী’-দের দমন করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশার দায়ে তাদের বিচার হবে। ৯৩ বছর বয়সি মুগাবে নাকি সপরিবারে নিরাপদেই রয়েছে।

উল্লেখ্য, অশীতিপর মুগাবে-পরবর্তী জিম্বাবোয়ের ক্ষমতাকেন্দ্রে আধিপত্য নিয়ে এর মধ্যেই সংঘাত শুরু হয়ে গেছে৷ ১৯৮০ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পর মুগাবেই একটানা ক্ষমতায় ছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে মুগাবের ৫২ বছর বয়সি স্ত্রী গ্রেস-এর নেতৃত্বে ‘জি-৪০’ নামে এক গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সহযোগীদের কোণঠাসা করে দেওয়ায় সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল কনস্টানটিনো চিওয়েঙ্গা ২৪ ঘণ্টা আগেই হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। গ্রেস শিবির দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মেনানগাগওয়াকে বরখাস্ত করার পর তিনি হস্তক্ষেপ করতে দেরি করেননি। মোটকথা গ্রেস মুগাবে যাতে তাঁর স্বামীর উত্তরসূরি না হতে পারেন, সামরিক বাহিনী তা নিশ্চিত করতে চায়।
মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধাদের সঙ্গে গ্রেস মুগাবের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের নেতাদের সংঘাতের ফলে দেশে অনিশ্চয়তা বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গ্রেস শ্বেতাঙ্গ চাষিদের ফিরিয়ে আনার যে উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, ‘ওয়ার ভেটারান’-রা তা মোটেই পছন্দ করছেন না। মুগাবের ঘনিষ্ঠ মহলের অনেকেও গ্রেস-এর উত্থানের বিরোধিতা করেছেন। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিম্বাবোয়েতে অবস্থানরত নিজেদের নাগরিকদের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রকাশ্যে না আসার পরামর্শ দিয়েছে। যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়, তাদের বাসভবনে থাকতে বলা হয়েছে।

একান্ত বাধ্য হয়ে অবশেষে পদত্যাগ করেছেন জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার জ্যাকব মুডেন্ডা একথা বলেছেন। তাকে দেয়া এক চিঠিতে মুগাবে বলেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন এবং ক্ষমতার হন্তান্তর যাতে ঝামেলা পূর্ণ না হয়, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
এই ঘোষণা এমন এক সময় আসে যখন পার্লামেন্টে এমপিরা তাকে অভিশংসনের একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তবে মি. মুগাবে পদত্যাগ করেছেন এ খবর আসার পর সে প্রক্রিয়া থেমে যায়। পার্লামেন্ট সদস্যরা উল্লাসে চিৎকার করতে থাকেন। শহরের রাস্তাগুলোতেও জনতা নেমে এসে উল্লাস করতে থাকে।
পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা এখনো বলা হয় নি। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মেনানগাগওয়ার নামই বলা হচ্ছে সবার আগে। তিনি এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে অজ্ঞাত স্থান থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত বলে জানিয়েছিলেন।
সম্প্রতি সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর থেকে রবার্ট মুগাবে গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। সেখান থেকেই দেয়া এক টিভি ভাষণে তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেছিলেন। জিম্বাবুয়ে ১৯৮০ সালে স্বাধীন হবার পর থেকেই মি. মুগাবে ক্ষমতায় ছিলেন। তবে সম্প্রতি ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মেনানগাগওয়াকে বরখাস্ত করার পরই রবার্ট মুগাবের বিরুদ্ধে তার জানু-পিএফ পার্টি ও সামরিক বাহিনীতে ক্ষোভ তৈরি হয়।
তিরানব্বই বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের পর জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হবার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন তার স্ত্রী গ্রেস মুগাবে এবং মি. মানাঙ্গাগওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে নিজের স্ত্রীর পক্ষ নেন মুগাবে এবং মেনানগাগওয়াকে তার ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেন। আর এই ঘটনার পরই সম্প্রতি জিম্বাবুয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সেনাবাহিনী। এ সময় প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেকে গৃহবন্দী করে তারা। মুগাবে এমন একজন রাজনীতিক ছিলেন। যিনি দশকের পর দশক তাঁর দেশের নিয়তি ঠিক করেছেন। কিন্তু এখন তাঁর সমালোচক আর সমর্থকরা তাকে নিয়ে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

জিম্বাবুয়ের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের জায়গায় কে আসবেন, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জল্পনা-কল্পনা চলছে। মি. মুগাবের বয়স এখন ৯৩ বছর। গত ৩৭ বছর ধরে তিনি ক্ষমতায় রয়েছেন। কিন্তু এত বয়স হওয়ার পরও তিনি থামতে রাজি নন। আগামী বছর সাধারণ নির্বাচনে দল তাকেই আবার মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু এর ফলে দলের মধ্যে ক্ষমতার কোন্দল কমেনি। বরং বেড়েছে। এখানে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মেনানগাগওয়া এবং মি. মুগাবের স্ত্রী গ্রেস। মি. মেনানগাগওয়া একজন খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা। আর গ্রেস মুগাবের উত্থান একেবারেই নাটকীয়।
গ্রেস মুগাবের রাজনৈতিক উত্থান ছিল দ্রুত এবং চমকপ্রদ। তিনি মি. মুগাবে’কে বিয়ে করেন ১৯৯৬ সালে। তখন তার ভূমিকা ছিল একজন ফার্স্ট লেডির। কিন্তু এর পরের বছরগুলিতে তিনি নিজেকে পাল্টাতে শুরু করেন। তিনি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। চালু করেন অনাথ আশ্রম। ২০১৪ সালে তিনি ক্ষমতাসীন দল জানু পিএফ-এর নারী শাখার প্রধান নিযুক্ত হন। এই পদাধিকার বলে তিনি দলের প্রেসিডিয়ামেও জায়গা পান। সেই একই বছর তিনি ষড়যন্ত্র করে ভাইস প্রেসিডেন্ট মুজুরুকে দল থেকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর তিনি মনোযোগ দেন জি-৪০ নামে পরিচিত দলের তরুণ নেতাদের জোটের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার কাজে। এদেরকে তিনি এমারসন মেনানগাগওয়ার নেতৃত্বাধীন জোট, যার নাম টিম ল্যাকোস্ট-এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন।

এক সময়ে জি-৪০ এবং টিম ল্যাকস্টের মধ্যে ঝগড়া চরমে পৌঁছে। জানু পিএফ-এর এক সমাবেশ হয় চলতি বছর আগস্ট মাসে। সেখানে একটি আইসক্রিম খেয়ে মি. মেনাঙ্গাগওয়া এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। অভিযোগ করা হয় যে আইসক্রিমটি তৈরি হয়েছিল গ্রেস মুগাবের এক ডেইরি ফার্ম থেকে। মিসেস মুগাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। মি. মেনানগাগওয়া পরে বলেন, তাকে ঠিকই বিষ খাওয়ানো হয়েছিল, কিন্তু এর পেছনে ফার্স্ট লেডি থাকতে পারেন এমন কথা বলাই ‘মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। এরপর থেকেই গ্রেস মুগাবে মি. মেনানগাগওয়ার পদত্যাগ দাবি করতে থাকেন।
নবেম্বর মাসে এমারসন মেনানগাগওয়াকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। তথ্যমন্ত্রী সাইমন খায়ময়াও সে সময় বলেছিলেন, ভাইস প্রেসিডেন্টের মধ্যে ‘আনুগত্যহীনতার লক্ষণ’ দেখা গিয়েছে। এক কালে রবার্ট মুগাবের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এবং গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান মি. মেনানগাগওয়াকে যখন প্রাণনাশের হুমকি দেয়া শুরু হয়, তখন তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

মি. মেনানগাগওয়া বরখাস্ত হওয়ার এক সপ্তাহ পর জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনীর তরফে এক বিরল বক্তব্য দেয়া হয়। সেনাবাহিনীর ৯০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাশে নিয়ে জেনারেল কনস্টানটিনো চিওয়েঙ্গা ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, মি. মেনানগাগওয়ার মত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সরিয়ে দেয়া সেনাবাহিনী বরদাশত করবে না। এই হুমকি দেয়ার দু’দিন পর সেনাবাহিনী জিম্বাবুয়ের ক্ষমতা দখল করে। পরে জনমত ও সেনাবাহিনীর চাপের মুখেই তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
মূলত রবার্ট মুগাবের পদত্যাগের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ের রাজনীতিতে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। স্বাধীনতাকামী ও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই মুগাবের উত্থান হলেও তার যবনিকা ঘটেছে স্বৈরাচার ও একনায়কের তকমা নিয়ে। সেদেশর জনগণ ও সেনাবাহিনী আপাতত মুগাবের বিদায়কে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু মুগাবে পরবর্তী দেশটির রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেয় তা নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি। তবে জিম্বাবুয়োর আগামী দিনগুলো খুব প্রীতিকর হবে বলে আস্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না। তবে সময় সব কিছু বলে দেবে।

http://www.dailysangram.com/post/308791