২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:২৮

শহীদ মুজাহিদ আপোষহীন সংগ্রামের এক প্রতিচ্ছবি

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস বলেছেন, “আমার মতে ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনো এতটা অসহায়ত্ব বোধ করেনি”। বেকন বলেছিলেন- “আইনের মাধ্যমে অত্যাচার করার চেয়ে বড় অত্যাচার আর নেই।” সেই অত্যাচারের শিকার হয়েছেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। ২২ নভেম্বর ২০১৫ ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিন দু’জন দেশপ্রেমিক নাগরিককে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে হত্যা করলো যা সৃষ্টি করলো এক কালো অধ্যায়ের। হত্যার সাথে জড়িত অনেকে আজ আমাদের চোখের সামনে অপমান অপদস্ত, জনগণের ঘৃণায় অভিশাপে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনেকে উচ্চ আসন থেকে অপসারিত হতে শুরু করেছে। আল্লাহর ঘোষণা- “বলুন ইয়া আল্লাহ! আপনিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পততি করেন। আপনার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।” (সূরা- আল ইমরান ঃ ২৬)

হত্যা করে ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে বিদায় করা যায় মানুষের ভালোবাসা থেকে আলাদা করা যায় না। শহীদ মুজাহিদ মরে নাই, বরং অমর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। অনেকে আপনজনের জন্য দোয়া করতে ভুলে যান কিন্তু তাঁদের প্রিয় নেতাদের জন্য চোখের পানি ফেলেন নিজের অজান্তে। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে তাদেরকে স্মরণ করেন গোটা মুসলিম উম্মাহ। শহীদেরা কালোত্তীর্ণ, অমর, শ্রেষ্ঠবীর ও জাতির সুযোগ্য সন্তান। তাদের রক্তের বিনিময়ে একদিন এ জমিনে কালেমার পতাকা উঠবেই ইনশাআল্লাহ।

আওয়ামী লীগ আদর্শকে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে জামায়াতের আমীর, সেক্রেটারিসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক এই ক্ষত শেষ হয়ে যাবে না। দার্শনিক সক্রেটিসকে হ্যামলক বিষ প্রয়োগে হত্যার রায় দিয়েছিল আদালতেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আদালতের নির্দেশেই। হাজার বছর পর এসে প্রমাণিত হয়েছে আদালতের দুটি রায়ই ভুল ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে হয়ত একদিন এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও তাই প্রমাণিত হবে।

শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একটি বিপ্লবী নাম, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস, একটি আপোষহীন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ জাতি শ্রদ্ধার সাথে ইসলামী আন্দোলনের এই সিপাহসালারকে হৃদয়ের আবেগ আর ভালোবাসায় সিক্ত করবে শতাব্দী থেকে শতাব্দী। এই ভূ-খণ্ডে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে শহীদ মুজাহিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শহীদ মুজাহিদ ছিলেন আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী  চেতনার বিপরীতে একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ট্রাইব্যুনালের রায় শুনে তিনি বলেছিলেন, “সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে তার জন্য আমি মোটেই বিচলিত নই। আমি আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্যে আমার জীবন কুরবান করার জন্য সব সময় প্রস্তুত আছি।” তাঁর এই সাহসী উচ্চারণ থেকে তরুণ প্রজন্ম, এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেতনা খুঁজে পাবে।

বাংলার জমিনে নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর রক্তচক্ষু মোকাবেলা করে তৃণমূল থেকে গড়ে উঠে আসা একজন সংগ্রামী প্রাণপুরুষ। নীতির প্রশ্নে সদা আপোষহীন এই মানুষটিকে কেবলমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের অপরাধ, তারা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে।” আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (২ ঃ ১৫৪)। প্রিয় রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিযী)

এই ক্ষণজন্মা, মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি। তাঁর পিতা প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুল আলীর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে শিক্ষার হাতেখড়ি। জনাব মুজাহিদের পিতা মাওলানা আব্দুল আলী একজন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আজও ফরিদপুরসহ গোটা অঞ্চলের মানুষের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র। ১৯৬২-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

ছাত্র জীবনে এই মেধাবী চৌকস সচেতন মানুষটি ছাত্র-সমাজের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শীর্ষে থেকে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন। কর্মজীবনেও রেখেছেন গৌরবোজ্জল ভূমিকা। জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠাসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। শহীদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে জেল, জুলুম এবং নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। ১/১১ সরকার তথাকথিত দুর্নীতির মিথ্যা মামলা দিয়েও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া যাদের মিশন আর আল্লাহর নিকট প্রতিটি কর্মের জবাবদিহির চেতনা লালন করেন তারা কি দুর্নীতি করতে পারেন? সাবেক মন্ত্রী শহীদ মাওঃ মতিউর রহমান নিজামী ও শহীদ আলী আহসান মুজাহিদ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতীক হয়ে থাকবেন।
শহীদ মুজাহিদ ছিলেন ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অনুপম কারিগর। মন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কায়েম করেছেন সততা, ইনসাফ, সত্যবাদিতার উজ্জল উদাহরণ। আত্মত্যাগ, আন্তরিকতা, নিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ প্রেমের স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন। তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। (চলবে)

http://www.dailysangram.com/post/308795