২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৪

সিএনজি অটোরিকশার নৈরাজ্য থামছে না

মিটার ও স্বল্প দূরত্বে যেতে নারাজ অধিকাংশ চালক * নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি জমা নেন মালিকরা

আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কুড়িল যাবেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বিল্লাল আহসান। ওই ভবনের সামনে থাকা ঢাকা-মেট্রো থ ১৩-২০২৭ নম্বরের সিএনজি চালক নজরুল ইসলামকে গন্তব্যে যাওয়ার কথা বলেন ওই কর্মকর্তা। চালকও রাজি হন, কিন্তু ভাড়া হাঁকেন ৩৫০ টাকা। বিল্লাল আহসান মিটারে যাওয়ার অনুরোধ করলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মিটারে যাওন যাইব না, সমস্যা আছে।’ পরে ভাড়া ৫০ টাকা কমিয়ে ৩০০ টাকার এক পয়সা কমেও যেতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন চালক নজরুল। পরে অন্য সিএনজিতে ২৫০ টাকায় কুড়িলের উদ্দেশে রওনা দেন বিল্লাল। এর আগে তার অভিযোগ, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন চিত্র নয়। প্রায়ই সিএনজি অটোরিকশা চালকরা এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া নেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিআরটিএ এসব অনিয়ম দেখছে না বলেও অভিযোগ তার।

বর্তমানে রাজধানীতে অ্যাপভিত্তিক সার্ভিস যেমন উবার, পাঠাও, স্যাম, বাহন চালু হওয়ার পর অনেকটা বেকাদায় পড়েছেন সিএনজি অটোরিকশা চালকরা। আগের চেয়ে তাদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমলেও মিটারে যেতে চান না বেশিরভাগ চালক। এতে ক্ষোভে ফুঁসছেন অনেক যাত্রী। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সিএনজি অটোরিকশা ধর্মঘটের ডাক দেয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুর রউফ বলেন, বনানী থেকে উত্তরায় সিএনজি অটোরিকশায় ভাড়া আগে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা নিত। এখন নেয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। উবার, পাঠাওসহ অ্যাপভিত্তিক সেবা মাঠে নামার পর সিএনজি অটোরিকশার দৌরাত্ম্য কিছুটা কমেছে বলে মনে করেন তিনি। এ শিক্ষার্থী বলেন, সিএনজি চালকরা ধর্মঘট ডেকেছেন। আমরা তা সমর্থন করছি। সিএনজি ছাড়াই আমরা অ্যাপভিত্তিক সার্ভিসে ভালো আছি।

অ্যাপভিত্তিক সেবা চালু হলেও সিএনজি অটোরিকশার নৈরাজ্য বহাল রয়েছে বলে জানান যাত্রী আবদুল গফুর। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাজধানীর নাখালপাড়া থেকে সচিবালয় যেতে সিএনজিচালক ভাড়া চেয়েছেন ২৫০ টাকা। পরে ২২০ টাকায় রফা হল। উপায় নেই, অফিসে যেতেই হবে। এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। বিচার দেব কার কাছে? বিচার করবেই বা কে? তিনি বলেন, কোনো জায়গায় যেতে চাইলেই সিএনজি চালকরা নানা অজুহাতে দেখিয়ে মিটার অনুযায়ী ভাড়ায় যেতে রাজি হন না। অজুহাতের মধ্যে রয়েছে- সিএনজি মালিক নির্ধারিত জমার চেয়ে বেশি আদায় করেন, মিটার নষ্ট, রাস্তা খারাপ ইত্যাদি।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী সিএনজি অটোরিকশার এসব সমস্যা অনেকটা স্বীকার করেন। তিনি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বখশিশের নামে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া, মিটারে না গিয়ে ভাড়া নিয়ে কন্ট্রাক্ট করা, মালিকের অতিরিক্ত জমা নেয়ার অভিযোগ আমরা পেয়ে থাকি। এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে বিআরটিএ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অনলাইনে যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেসব চালকের লাইসেন্স স্থগিত ও মালিককে ডেকে কাগজপত্র জব্দ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সিএনজি অটোরিকশার দৌরাত্ম্য কমাতে আমরা রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা তৈরি করছি। এতে প্রতিযোগিতার মুখে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হবে। পাশাপাশি উৎসমুখ অর্থাৎ গ্যারেজেও অভিযান চালাচ্ছি।

যাত্রীদের অভিযোগ, রাজধানী ঢাকার প্রায় সব এলাকার চিত্র কমবেশি একই রকম। মিটারে কোনো সিএনজিচালক যেতে চান না। এছাড়া মিটারে যেতে চাইলেও আবদার থাকে ২০ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেয়ার। সিএনজি মালিকরা জমা (ভাড়া) বেশি নেন, অনেক যাত্রী জ্যামে পড়লে মিটার বন্ধ করতে বলেন কিংবা নেমে যান এসব কারণে চালকরা ভাড়া বেশি নিয়ে থাকেন বলে কয়েকজন চালক স্বীকার করেন। আর যাত্রীরা বলছেন, সিএনজি অটোরিকশার নৈরাজ্য চলছে। কোনোভাবে তা থামছে না। এর খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকেই। রাস্তায় বেরোলেই সিএনজি অটোরিকশায় চড়তে গিয়ে সীমাহীন যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা হচ্ছে।

সিএনজি অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানান, রাজধানী ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার নতুন ভাড়ার হার ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়। নতুন ভাড়া অনুযায়ী অটোরিকশার প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১২ টাকা করে। প্রতি এক মিনিট বিরতির (যাত্রাবিরতি, যানজট ও সিগন্যাল) জন্য দুই টাকা। আর মালিকের জমা নির্ধারণ করা হয় ৯০০ টাকা। ওই সময়ে ভাড়া ও জমা দুটোই বাড়ানো হয়।

কয়েকজন চালক অভিযোগ করেছেন, সরকার নির্ধারিত সিএনজি জমা ৯০০ টাকা। কিন্তু অনেক মালিক হাজার টাকা আবার অনেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত জমা নেন। এ অবস্থায় সিএনজি চালকদের করণীয় কী, তা তারা জানতে চান। চালকরা বলছেন, বর্তমান বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সকাল ৮টায় একটি সিএনজি নিয়ে বের হলে জমা তুলতে বিকাল ৪টা কিংবা ৫টা বেজে যায়। এরপর ২ বেলা খাবার খাওয়ার জন্য অন্তত ১ ঘণ্টার বিরতি দিতে হয়। এসব করার পর একজন সিএনজিচালকের নিজের জন্য টাকা থাকে খুব সামান্য। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক পুলিশকে যে টাকা দিতে হয়, সেটাও অনেক বড় সমস্যা বলে জানান চালকরা। বাড়তি জমা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মালিকরা। সিএনজি অটোরিকশার একজন মালিক মোস্তাফিজুর রহমান জমা বেশি নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, জমা ৯০০ টাকাই নেয়া হয়। অনেক সময় চালকরা বাড়তি ভাড়া নিতে মিথ্যা দোষারোপ করে।

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/25/174564