২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১১

কাগুজে জিডিপিতে সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ

অর্থনীতির সুফল আর কুফল নিয়ে কোন তর্ক না থাকলেও বিতর্ক চলছে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে। বিতর্ক চলছে এই প্রবৃদ্ধির আকার বা অঙ্ক নিয়েও। জিডিপি নিয়ে এই বিতর্ক নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই এই বিতর্ক চলছে। প্রতি বছরই কিছুটা হলেও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু কাগুজে এই জিডিপিতে সাধারণ জনগণ কোনো সুফল পাচ্ছে না। তবে চলতি অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিজনেস মনিটর ইন্টারন্যাশনাল- বিএমআই। সেই সাথে চলতি হিসাবের ভারসাম্য নেতিবাচক হয়ে পড়ায়, কমার আশঙ্কা রয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার মান। সংস্থাটির এমন বিশ্লেষণ, অমূলক নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, সাধারণ মানুষের শ্রমে দেশ এগিয়ে চলছে। কিন্তু উন্নয়নের নামে প্রতিনিয়ত সরকার ঋণ করে চলছে। এতে করে মানুষের মাথা পিছু ঋণ বাড়ছে। ঠিক এই মুহূর্তে যে শিশুটির জন্ম হলো, তারও মাথাপিছু ঋণ প্রায় ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। আর মাথাপিছু প্রদর্শিত আয় ১৬১০ ডলার। এ কারণে বিশাল অংকের টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে সুদ পরিশোধে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুধু সুদ পরিশোধে যত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো একটি সেতু নির্মাণ করার পরও আরও টাকা বেঁচে যাবে।

শুধু তাই নয় আমাদের এই কাগুজে জিডিপি যে হারে বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বাড়ছে না দেশে বিনিয়োগের পরিমানও। আর এ কারণেই এটিকে কাগুজে জিডিপি বলা হচ্ছে। যে হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেহারে যদি দেশে কর্ম সংস্থান হতো তাহলে বেকার থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রতি বছরই বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আর এ কারনেই প্রশ্ন উকি দিচ্ছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে। যদিও পরিসংখ্যার ব্যুরো বলছে সব নিয়ম মেনেই তারা কাজ করছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো কারণ নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের জিডিপি বাড়লেও কোন লাভ নেই। সাধারণ মানুষ এর কোন সুফল পাচ্ছে না। আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না।
সাধারণ মানুষের শ্রম ও ঘামে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির চাকাও সচল রেখেছে ব্যক্তিখাত। মূলত ব্যক্তিখাতের অবদানের প্রেক্ষিতে সরকারি হিসাবে গেল অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। যদিও এনিয়ে দেশি-বিদেশি সংস্থার রয়েছে ভিন্নমত। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই বলছে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলতি বছর শেষে দাঁড়াবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। যা আগামী ২০১৮ সালে কমে আসবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে। বিএমআই আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব বিস্তারকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান হওয়ায়, তাদের এমন মূল্যায়ন ভাবিয়ে তুলেছে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণকারী প্রতিষ্ঠান বিডাকেও।
সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক টানাপোড়ন বাড়ছে। যা ভবিষ্যতে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। এর ফলে বর্তমান ব্যবসার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে। বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ভারসাম্যও জিডিপির অনুপাতে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। আসছে বছর তা আরো কমে মাইনাস ১ ভাগে ঠেকবে বলে মনে করছে বিএমআই রিসার্চ। যে কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটবে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার দর কমে ৮৪ টাকায় ঠেকবে বলে আভাস দিয়েছে সংস্থাটি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকারকে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত। এটি হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক ইন্ডিকেটর। আগামী বছর নির্বাচনী হওয়াতে রাজনৈতিক অস্তিরতা দেখা দিতে পারে। যা আমাদের অর্থনিিততে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে অনেকে মনে করেন। আর এ কারনে আগামী জিডিপের প্রবৃদ্ধি কমতে পারে।
তিনি আরও বলেন, জিডিপি নিয়ে বির্তক নতুন কিছু নয়। কিন্তু জিডিপি বাড়লেও তার কোন সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হলো উন্নয়নের নামে সারা দেশে অপচয় হচ্ছে। হচ্ছে গনহারে দুনীতি। যদি এ সব দুর্নীতি কমানো না যায় তাহলে মাথা পিছু ঋণ আরও বাড়বে। মাথা পিছু ঋণ আর আয় বৃদ্ধি পেলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন নেই।

দাতারা বলছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ থেকে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হবে। এবারের অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির এই প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, প্রায় এক দশক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্তে বন্দী থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ৭ শতাংশের ‘ঘর’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। চূড়ান্ত হিসাবে সেটি হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
এদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। সরকারের ৭ দশমিক ৪ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। কারণ, প্রবৃদ্ধি অর্জনের যেসব খাতের ওপর নির্ভর করছে, সেগুলোর অবস্তা আশানুরূপ নয়। যেমন রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় নিম্নমুখী, বেসরকারি বিনিয়োগ ও কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও একই প্রবৃদ্ধি অপরিবর্তিত থাকবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। অতীতের ও চলতি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। তবে মধ্য আয়ের দেশ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাই বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য বলে এডিবি জানায়।

তাদের বিশ্লেষণ, চলতি অর্থবছরে কৃষিক্ষেত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে এটি আরও কিছুটা কমে হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমে হবে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে হবে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। কৃষির প্রবৃদ্ধি ওইভাবে কমেনি। কিন্তু জিডিপিতে অবদান কমেছে। কারণ শিল্পসহ অন্যান্য খাত এগিয়ে গেছে। দেশে রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। সুতরাং এটা আপাতত প্রবৃদ্ধিতে খুব বেশি চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে না।
জানা গেছে, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও তাতে উল্লাসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক্ষুদ্র শিল্পে এবং কনাস্ট্রাশন খাতে মূলত প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু এসব খাতে অতি দ্রুত উৎপাদনশীল নয়। আর এ কারণে সুফল পায় না সাধারণ জনগণ। অন্যদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ¦ালানিসহ মাঝারি শিল্প খাতে জিডিপির অবদান কমছে। যা অর্থনীতিতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। এসব খাতে সরকারের নজর থাকলেও সুফল পাচ্ছে না দেশবাসি। উপাদনশীল এসব খাতে বিনিয়োগ অনুযায়ী কর্মসংস্থানও হচ্ছে না।
সেবা খাতে ২০১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ ২০১৮ সালে অপরিবর্তিত থাকবে। আগামী অর্থবছর এই প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে দাঁড়াবে।

এদিকে এডিবির মতো বিশ্বব্যাংকও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে সরকারের প্রত্যাশার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয়। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। তাদের পর্যবেক্ষণ, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে। মূলত অবকাঠামো খাত ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে সরকার প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ অবস্থায় বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদের ব্যাখ্যা হলো, চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের যে প্রবাহ রয়েছে, তাতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করাও সহজ হবে না।
প্রবাসী আয়ের নিম্নপ্রবাহ ও নিম্ন ভোক্তা চাহিদার অর্থবছরে (২০১৭-১৮) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। পরের অর্থবছরে তা কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। এর পরের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ স্পর্শ করবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে চলতি বছরে ভারত ও ভুটানের পরেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেশি হবে। সবচেয়ে বেশি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে ভুটানে। যদিও দেশটির প্রবৃদ্ধি পঞ্জিকাবর্ষ ধরে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০১৭-১৮) ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। নেপাল ও পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি হবে যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, মালদ্বীপে সাড়ে ৩ শতাংশ ও আফগানিস্তানে ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
অর্থমন্ত্রী এই প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি তিনি বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা না কাটা, প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। তবে তিনি এখাতে আয় বাড়াতে রেমিট্যান্সের উপর মাশুল প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, জিডিপির ২৬ থেকে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত যে বিনিয়োগ হচ্ছে, তা মূলত সরকারি খাতে বিনিয়োগের কারণে। বেসরকারি খাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) যা ছিল, সেখানেই আছে। তবে বেসরকারি বিনিয়োগে যে স্থবিরতা ছিল, তা এখনো রয়ে গেছে।

প্রতিবেদনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে জিডিপি-শেয়ারবাজার মূলধন অনুপাত তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, এ অঞ্চলে জিডিপি-শেয়ারবাজার মূলধন অনুপাত সবচেয়ে বেশি হংকংয়ে। দেশটির জিডিপির ১০ গুণের বেশি শেয়ারবাজারের মূলধনের পরিমাণ। বর্তমানে হংকংয়ের জিডিপির আকার প্রায় ৩১০ বিলিয়ন ডলার। আর দেশটির পুঁজিবাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করেছে তিন হাজার ৩০১ বিলিয়ন ডলার। তারপরেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক চলছে।

http://www.dailysangram.com/post/308967