২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:০৮

নগদনারায়ণের অনিবার্য দাসত্বশৃঙ্খলেই কি বাঁধা তারা?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : একশ্রেণির আদম মনে করেন, নাস্তিক না হলে বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। নাস্তিক হবার জন্য ইসলাম, কুরআন, হজ-জাকাত, মসজিদ, মাদরাসা এসবের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা, বিবৃতি দিলে, দুই-একখান চটি বই লিখলেই কেল্লাফতে। বুদ্ধিজীবী হতে কোনও সমস্যা থাকবে না। আর ভাগ্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে প-িতি করবার সুযোগ জুটলেতো কথাই নেই। যেন সোনায় সোহাগা।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলিম প্রফেসর আবদুস সালাম ঢাকায় এসে যখন বক্তৃতার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বললেন, তখন ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা হকচকিয়ে গেলেন। বিস্ময়ে তাদের চক্ষু যেন চড়কগাছ হয়ে যায়। এব্যাপারে একটি মজার তথ্য পাওয়া গেছে ফেসবুক থেকে।
প্রখ্যাত ও নন্দিত ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার, টিভিসিরিয়াল নির্মাতা হুমায়ূন আহমদ (তিনি নিজের নামের শেষাংশ লিখতেন এভাবে ‘আহমেদ’) এর সাক্ষাতকার নেবার সময় অভিনেতা ও সাংবাদিক মাহফুজ আহমদ একটি প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটি ছিল, ‘এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?’
হুমায়ূন আহমদের সাবলীল উত্তর ছিল এমনÑ “আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজে যারা আছেন, তাদের কার্যক্রম খুব একটা পরিষ্কার না। এরা কেন জানি ইসলামকে খুব ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টানসহ অন্য যেকোনও ধর্মের প্রায় সব উৎসবে আমাদের এই বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত থাকেন। বক্তৃতা করেন। বাণী দেন। কিন্তু ইসলামী কোনও জলসায় কেউ উপস্থিত থেকেছেন বলে শোনা যায় না। তাদের মতে, ইসলামী জলসায় কেউ উপস্থিত থাকা মানে তার বুদ্ধিবৃত্তিও নিম্নমানের। সে একজন প্রতিক্রিয়াশীল। সাম্প্রদায়িক লোক। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খৃস্টানদের কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অর্থ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা, প্রগতির চর্চা করা, সংস্কারমুক্ত হওয়া ইত্যাদি।
প্রফেসর সালামের বক্তৃতার শুরুতে বিসমিল্লাহ থাকায় এখানকার বুদ্ধিজীবীদের হকচকিয়ে যাবার কারণটা হলো: তাদের কাছে প্রগতিশীল হওয়া, বুদ্ধিজীবী হওয়া, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা মানেই ইসলামবিরোধী হতে হবে। তাদের কাছে রামকৃষ্ণের বাণী, যিশুর বাণী সবই গ্রহণীয়। এসব তারা উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বাণী কখনও তাদের মুখ থেকে শোনা যায় না। তাদের কাছে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বাণী গ্রহণযোগ্য নয়।”

হুমায়ূন আহমদ আবারও বলেন, “আমার মতে, পৃথিবীর তাবৎ ঔপন্যাসিক যার কোটের পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তার নাম দস্তয়ভস্কি। আরেকজন আছেন মহামতি টলস্টয়।
এক রেলস্টেশনে যখন টলস্টয় মারা গেলেন, তখন তার ওভারকোটের পকেটে একটি বই পাওয়া গেছে। বইটি ছিল টলস্টয়ের খুব প্রিয়। সব সময় সঙ্গে রাখতেন। সময় পেলেই পড়তেন। বইটি হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বিভিন্ন সময়ে বলা ইন্টারেস্টিং কথাগুলো নিয়ে গ্রন্থিত।
আমি বিনয়ের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে জানতে চাইছি, আপনাদের ক’জন বইটি পড়েছেন? টলস্টয় যে বইটি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সেই বই আমাদের প্রত্যেকের একবার কি পড়া উচিত নয়? আমার মতে, প্রতিটি শিক্ষিত ছেলেমেয়ের বইটি পড়া উচিত।”

প্রসঙ্গত হুমায়ূন আহমদ আরও উল্লেখ করেন, “আমি ইসলাম পছন্দ করি জানবার পর একজনের মন্তব্য ছিল, ‘আমি তোকে অনেক উদারমনা ভেবেছিলাম।’ মানে আমি ইসলাম পছন্দ করি, এটা জানবার আগ পর্যন্ত আমার সকল কর্মকা- তার কাছে উদার ভাবাপন্ন লেগেছিল। কিন্তু জানবার পর থেকে আমি অনেক অনুদার হয়ে গিয়েছি।” -ঘরেবাইরে হুমায়ূন আহমদের হাজার প্রশ্ন, মাহফুজ আহমদ।
হুমায়ূন আহমদ নির্দ্বিধায় সত্যকথা স্বীকার করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। নিজেকে নাস্তিক বা আল্লাহবিদ্বেষী হিসেবে তুলে না ধরে দীনের প্রতি বিশ্বাসীরূপে তুলে ধরতে সাহসী হয়েছেন। এতে অন্যরা কী বলবেন বা মনে করবেন তা আদৌ পরোয়া করেননি। তিনি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী এটা কেউ জেনে ফেললে তার জনপ্রিয়তা কমে যাবে এমন মানসিকতা ছুঁড়ে ফেলেছেন। হীনম্মন্যতায় ভোগেননি। উল্লেখ্য, টলস্টয়ের মৃত্যুর সময় যে-বইটি পাওয়া যায় সেটি হাদিসের সংকলন।

অনেকে নিশ্চয়ই কোলকাতার টিভিসিরিয়ালগুলোতে লক্ষ্য করেছেন, কোনও না কোনওভাবে পূজো-অর্চনার অবতারণা করা হয়। এতে তারা ছোট হন না বা হীনম্মন্যতায় ভোগেন না। কিন্তু আমাদের এখানে তার বিপরীত। এখানকার নাটক-সিনেমায় আল্লাহ-রসুল, সালাত-সিয়াম এসব প্রসঙ্গ আনা মানা। এগুলো মৌলবাদী তথা ধর্মান্ধদের কাজ। কেউ কেউতো আগ বাড়িয়ে এসবকে স্বাধীনতাবিরোধী কার্যকলাপ বলেও উল্লেখ্য করতে ভোলেন না। শুধু কি তাই? এখানকার কোনও কোনও টিভিচ্যানেলের রিপোর্টারতো হজক্যাম্প থেকে রিপোর্ট করতেও কোলকাতার ভাষা ব্যবহার করেন। আল্লাহর স্থলে বলেন সৃষ্টিকর্তা, ইবাদতের জায়গায় বলেন উপাসনা। কারণ মুসলমানি ভাষা ইউজ করলে তাদের মৌলবাদী হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। কেউ তাদের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাতেও ফেলে দিতে পারে।
একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন যারা ইসলামকে এড়িয়ে চলেন। মসজিদ-মাদরাসার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন। মওলবি-মাওলানারা মানুষ হিসেবে কেউ সামান্য ভুল করলেই তাদের তুলোধুনো করে ছাড়েন। কিন্তু অমুসলিমদের পূজোপার্বনে অংশ নিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এমনকি পূজোয় গিয়ে প্রসাদগ্রহণেও সমস্যা হয় না তাদের। ভূয়সী প্রশংসাও করেন। আপত্তি শুধু দীন ইসলামে।

অন্যকোনও সম্প্রদায়ের কেউ নিজের বিশ্বাস-বোধের প্রশংসা করতেই পারেন। এতে তাদের নিজধর্ম বা চিন্তাচেতনার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং নিষ্ঠতার প্রমাণ মেলে। একে দোষেরও কিছু বলা যায় না। তবে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জীবনবোধ বিশেষত ইসলামী আদর্শের মূলনীতির অযৌক্তিক সমালোচনা এবং মানবপ্রণীত প্রথাপদ্ধতির ভূয়সী প্রশংসা করে, তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কীইবা করবার থাকে!
যারা নাস্তিক, আল্লাহ আছেন এটা মানে না, আল্লাহকে দেখতে পায় না, তারা অন্ধ, বধির, অনুভূতিহীন। তবে তাদের অন্যধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল দেখা যায়। শুধু দীন ইসলাম সম্পর্কেই তাদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব দেখতে পাই আমরা। আসলে এদের আজলের মরা বলা হয়। এদের বিবেক মরে গেছে। এদের চোখ থেকেও নেই। শ্রবণশক্তি নেই। আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামত যারা অস্বীকার করে, তাদের অন্ধ ও বধির ব্যতীত কী বলে আখ্যায়িত করা যায়, আমার জানা নেই।
যারা ইসলামকে শ্রেষ্ঠ দীন, উত্তম আদর্শ, সেরা জীবনশৈলী, কুরআনকে শেষ আসমানি কিতাব এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে আখিরি নবী বা পয়গম্বর মানে না, তারা কালেমা তাইয়েবার মর্মার্থ বোঝে না। আর এর অর্থ বুঝতে না পারলে কারুর অন্তর্চক্ষুও উন্মীলিত হয় না।
আল্লাহ, তার নবী(স), কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কে বাজে এবং অসত্য বলবার জন্য ওরা নিয়োগপ্রাপ্ত। এজন্য তারা নিয়মিত মাসোহারাসহ অনেক বেনিফিট পেয়ে থাকে। বিদেশভ্রমণের আয়োজন থাকে। এমনকি মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাও। কাজেই এতো তাদের করতেই হবে।

সত্য বলতে কী, নাস্তিক্যবাদীরা এখন সারাবিশ্বে এতিম। ঠাঁইহীন। মুখ দেখাবার জো নেই বলা যায়। কোনওরকমে ছাল-বাকল আঁকড়ে থাকতে চেষ্টা করছে। এই যখন অবস্থা তখন এর অনিবার্যতা ছুঁড়ে ফেলে সোজাপথে ফিরতে সমস্যা কীসের? কবে তাদের চক্ষু উন্মীলিত হবে এবং আলোর মিছিল প্রত্যক্ষ করবে?
আসল কথা হচ্ছে, নগদনারায়ণের প্রতি যাদের আকর্ষণ প্রবল। তাদের হিতাহিত জ্ঞান বা বুদ্ধি-বিবেক বলে কিছু থাকে না। অর্থের পেছনে তাদের অক্লান্ত দৌড় অব্যাহত রাখতে হবেই। আমাদের মাননীয় বুদ্ধিজীবীরা নগদনারায়ণের জন্য মন-মগজ সবকিছু বন্ধক রেখেছে। কারুর মন না চাইলেও তা করতে হবেই। মান-সম্মান, বুদ্ধি-বিবেচনার চেয়ে নগদনারায়ণের অনিবার্যতা জরুরি বেশি। এখন অবশ্য সত্যদীনের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পশ্চিমা বিশ্ব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এর ছিটেফোঁটা কুড়িয়ে নিতে পারলেই নাস্তিক্যবাদের ধারক-বাহকদের প্রয়োজনের চাইতে অধিক। কাজেই ওপথ থেকে তারা ফিরবে কেন?

http://www.dailysangram.com/post/308894