২৩ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫১

ঠিকাদারদের হাতে জিম্মি খাদ্য অধিদপ্তর

সহায়তা করছেন অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা

ঠিকাদারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। দেশের বিভিন্ন স্থানে সেন্ট্রাল সাপ্লাই ডিপো (সিএসডি), লোকাল সাপ্লাই ডিপোগুলোতে (এলএসডি) বছরের পর বছর একই ঠিকাদার কাজ করে যাচ্ছেন। আইন অনুযায়ী, নতুন কোনো ঠিকাদার নিয়োগ দিতে গেলেই আদালতে মামলা করে দিচ্ছেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে তারা পাচ্ছেন বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা।

জানা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত ঠিকাদারদের একেকজনের একাধিক নামে ফার্ম (ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) রয়েছে। ফলে নতুন ঠিকাদার অন্তর্ভুক্ত হলে পুরনোদের ব্যবসায় লোকসান হয়। তাই নানা অজুহাতে তারা আদালতে মামলা করে ঠিকাদার নিয়োগের বিরুদ্ধে সাময়িক স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। এসব মামলায় বছরের পর বছর লড়ছে খাদ্য অধিদপ্তর। মামলার চাপে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে অধিদপ্তর। ঠিকাদারদের নানা কারসাজির সঙ্গে অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে। তারা সিন্ডিকেট করে পুরো ব্যবস্থা জিম্মি করে রেখেছেন।

খাদ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৩টি সিএসডি ও ৫৯০টি এলএসডি রয়েছে। গত মাসে ঠিকাদার নিয়োগের সার্বিক পরিস্থিতি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে তুলে ধরে খাদ্য অধিদপ্তর। সেখানে উঠে আসে নানা অজুহাতে ঠিকাদারদের মামলা এবং পরবর্তী জিম্মি অবস্থার বাস্তবচিত্র। সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ১৩টি সিএসডিতেই ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। আর এলএসডিগুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশে ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে।

এদিকে ঠিকাদাররা দাবি করছেন, সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এসব মামলার কারণে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে এমন প্রভাবশালী কতিপয় সুবিধাভোগী লোক নানা অজুহাতে মামলা করে ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ করে রেখেছেন। সার্বিক বিচারে এতে সরকার কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। কারণ, নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা না হলে সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হয়। ঠিকাদাররা বলেন, কমিশন বাড়ানোসহ অনেক ঠুনকো বিষয়ে এসব মামলা করা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে একাধিকবার খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমাধানও চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রীর দপ্তর থেকে আশ্বাস পাওয়া গেলেও তা আশ্বাস পর্যায়েই থেকে গেছে।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি খাদ্য অধিদপ্তর মনিটর করছে। তাই এ ব্যাপারে অধিদপ্তরই ভালো জানে।

খাদ্য অধিদপ্তরের চলাচল, সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের পরিচালক চিত্তরঞ্জন বেপারী বলেন, বিভিন্ন সময়ে ঠিকাদারদের মামলাগুলোর কারণে কাজে যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটছে। গতিও অনেক কমে আসছে। মামলাগুলো আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে অধিদপ্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আইন হয়েছিল, এক বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন না। এর পর থেকেই নানা অজুহাতে কারণে-অকারণে আদালতে মামলা করা হয়। মামলা দায়েরের পর আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে তারা বছরের পর বছর একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছেন।

কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইদুর রহমান বলেন, নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করতে যে কেউ আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। সে অধিকার থেকেই কতিপয় ঠিকাদার আদালতে মামলা করেছেন। বাদীপক্ষ উদ্যোগী না হলে এসব মামলা নিষ্পত্তি কঠিনই বলা যায়। ঠিকাদারদের ছোটখাটো দাবিগুলো নিয়ে একাধিকবার খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। তিনি আশ্বাস দিলেও পরে তার বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে খাদ্য অধিদপ্তর এবং মামলার বাদী দু'পক্ষের মতের অমিলই মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকার অন্যতম একটি কারণ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলার বাদী একটি বিশেষ সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বলেও তিনি দাবি করেন। এদের অনেকে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে শ্রম ও হ্যান্ডলিং ঠিকাদাররা কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন ঠিকাদার সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে পরিবহন ঠিকাদারদের মামলার সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটি।

অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৭ সালে ৪১ শতাংশ কমিশনের দাবিতে আদালতে মামলা করেন খুলনা অঞ্চলের ঠিকাদার নেতা মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। ওই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় গত ১০ বছরেও নতুন করে ঠিকাদার অন্তর্ভুক্তি করা হয়নি, হয়নি টেন্ডারও। জানা গেছে, খুলনা বিভাগে খাদ্য পরিবহনের (সড়কপথে) জন্য আরসি ফুডের কার্যালয় থেকে সর্বশেষ ২০০৪ সালে ঠিকাদার অন্তর্ভুক্তির টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে ২৭৫ জন ঠিকাদার অন্তর্ভুক্ত হয়, যাদের মেয়াদ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে শেষ হয়। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর পর ঠিকাদার অন্তর্ভুক্তির জন্য টেন্ডার আহ্বানের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রতিবছরই আগের অন্তর্ভুক্ত ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করে মেয়াদ বাড়ানো হয়। ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে ভাগবাটোয়ারা হয় খাদ্য বিভাগের শীর্ষ পর্যায় থেকে কয়েকজনের মধ্যে। ফলে কয়েকজন ঠিকাদারই এ অঞ্চলের খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাগেরহাটের নয়টি এলএসডিতে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। ঝালকাঠির এলএসডিগুলোতে ২০০৭-০৯ অর্থবছরের পর আর কোনো ঠিকাদার নিয়োগ করা যায়নি। জানা যায়, ২০১২ সালে ৩০ ভাগ বর্ধিত বিল পাওয়ার দাবিতে আদালতে মামলা করেন আ. মজিদ হাওলাদারসহ তিনজন শ্রম চালনা ঠিকাদার। ওই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখনও আটকে আছে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া। শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদার নিয়োগের জন্য আহ্বান করা দরপত্রের ওপর চারজন শ্রম চালনা ঠিকাদারের করা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বরিশালের ১০ এলএসডিতে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ওই এলএসডিগুলোতে ২০০৫-০৭ অর্থবছরে সর্বশেষ ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছিল। শ্রম ও হ্যান্ডলিং ঠিকাদারদের মামলায় সাতক্ষীরার নয়টি এলএসডিতে ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর থেকে নতুন কোনো ঠিকাদার নিয়োগ করতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর।

চট্টগ্রামের দেওয়ানহাট সিএসডির ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে আছে এক ঠিকাদারের মামলায়। নিয়োগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াকরণে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষ হয়। বর্তমানে মাস্টাররোলের মাধ্যমে সিএসডির কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। হালিশহর সিএসডির অবস্থাও একই। এসব সিএসডিতে মাস্টাররোলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। একই অবস্থা চট্টগ্রামের এলএসডিগুলোর। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় কক্সবাজার এলএসডিতে ২০১০-১২ অর্থবছরের পর থেকে ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। দেশের সব জেলার অধিকাংশ এলএসডিতেই ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার খাদ্য অধিদপ্তর।

http://samakal.com/bangladesh/article/17111471