২৩ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৬

৬৯ মাসে তদন্ত প্রতিবেদন পেছালো ৫২ বার

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার তারিখ ফের পিছিয়েছে। গত মঙ্গলবার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্ধারিত তারিখ ছিল। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা র্যা বের সহকারী কমিশনার মহিউদ্দিন আহমেদ কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেননি। পরে ঢাকা মহানগর হাকিম মাজহারুল হক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৬শে ডিসেম্বর নতুন দিন ধার্য করেছেন। আর এ নিয়ে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় ৬৯ মাসে তদন্ত প্রতিবেদনের তারিখ ৫২ বার পেছালো। এতে করে নিহতের পরিবারের সদস্যরা অনেকটা নিরাশায় আছেন।

তারা বলছেন- দিনের পর দিন যাচ্ছে। দুই মাস পর ৬ বছরে পড়বে। কিন্তু এই মামলার তদন্ত কার্যক্রম আর শেষ হয় না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যা ব সদর দপ্তরের সহকারী কমিশনার মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদি আগামী ২৬শে ডিসেম্বরের আগে সেই প্রতিবেদন আমাদের কাছে চলে আসে তবে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া যাবে। এছাড়া অন্যান্য তদন্তও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে ছেলে হত্যার বিচার না পেয়ে ভেঙে পড়েছেন সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মুনির। নিজের একমাত্র ছেলেকে হত্যার সাড়ে ৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনি এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। এখনো চোখ দিয়ে জল পড়ে অঝোর ধারায়। সাগরের মা সালেহা মুনির মানবজমিনকে বলেন, আমার ছেলেকে হত্যার বিচার আর এই দেশে হবে না। কিন্তু এই আসমান জমিন যতদিন থাকবে, আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিনই সাগর হত্যার বিচার চাইবো। আমি শুধু জানতে চাই, আমার ছেলের কি অপরাধ ছিল। কেন আমার একমাত্র সন্তানকে হত্যা করে আমার বুক খালি করা হলো। সাগর-রুনি হত্যা মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে এখন আর আমার যোগাযোগ হয় না। কারণ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে একেক জন একেক ধরনের কথা বলে। তারা আদৌ এই মামলার তদন্ত করছে কিনা বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, তদন্তে গাফিলতির কারণে বারবার এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে এই মামলার আজ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতিই দেখলাম না। আদৌ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হবে কিনা জানি না।

২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তাফা সারোয়ার ওরফে সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি দম্পতি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ বাসায় খুন হন। সাগর-রুনি খুন হওয়ার পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই)। চারদিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ১৮ই এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র্যা বের কাছে হস্তান্তর করা হয়। র্যা ব তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর সাগর-রুনির মরদেহ কবর থেকে তোলার আবেদন জানায়। পরে ২০১২ সালের ২৬শে এপ্রিল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদুজ্জামানের উপস্থিতিতে সাগর-রুনির মরদেহ তোলা হয়। তাতে পরীক্ষা করে দেখা যায়, নিহত সাগর-রুনিকে হত্যার আগে কোনো নেশাজাতীয় খাবার পানীয় দেয়া হয়নি এবং কোনো বিষও পাওয়া যায়নি।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ৮ মাস পর ২০১২ সালের ১০ই অক্টোবর বনানী থানার একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার থাকা ৫ আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে এ মামলায় রিমান্ড চাওয়া হয়। ওইদিনই রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান ও বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল এবং পরবর্তীতে অন্য দারোয়ান এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া মামলার তদন্তে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। পলাশ রুদ্র পাল ও তানভীর রহমান এখন জামিনে আছেন। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা র্যা ব। পরে র্যা বের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাগর-রুনির বাসার পলাতক দারোয়ান এনামুল হক ওরফে হুমায়ূনকে ধরতে পারলে হত্যাকাণ্ডের রহস্যজট খুলে যাবে। এ জন্য এনামুলকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি এনামুলকে গ্রেপ্তার করা হলেও খোলেনি রহস্যজট। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পর দুই দফায় ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। আলামতের তালিকায় ছিল হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি ছুরি, ছুরির বাঁট, সাগরের মোজা, একটি কম্বল, সাগরের পরনের প্যান্ট, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট প্রথম দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এসব আলামত থেকে দুজন ব্যক্তির সম্পূর্ণ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। পরে এ দুই ব্যক্তির প্রোফাইলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত নিহত সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর, দুই নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও এনামুল ওরফে হুমায়ূন কবীর এবং পাঁচ ডাকাত রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুনের চুল ও লালা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সে সময় বলা হয়েছিল, এ আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে তদন্তে নতুন মোড় নেবে। রহস্য উদঘাটনে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে। সেই পরীক্ষার একটি প্রতিবেদনও হাতে পেয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা। কিন্তু সেই ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে কারও ডিএনএ ম্যাচ করেনি। ফলে অধরাই থেকে গেছে খুনিরা।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=93254