২৩ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪১

নিশ্চিত হচ্ছে না ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার

সোয়া লাখ ফার্মেসির মধ্যে ২২৫টিতে ফার্মাসিস্ট আছেন * বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মের সম্পূর্ণ বিপরীত


দেশে ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার এখনও নিশ্চিত হয়নি। সরকারি হিসাব মতে সারা দেশে এক লাখ ২৪ হাজার ফার্মেসি রয়েছে। নিরাপদ ওষুধ নিশ্চিত করতে এসব ফার্মেসিতে গ্রাজুয়েট ও ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট থাকার কথা। কিন্তু ফার্মাসিস্ট আছে এমন ফার্মেসির সংখ্যা মাত্র ২২৫টি। এক থেকে দুই বছরের মধ্যে এগুলো গড়ে উঠেছে। ফলে ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার বাড়ছে। অথচ সুস্থ জাতি গঠনে ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের বেশির ভাগেরই দায়িত্ব পালন করার কথা কমিউনিটি ফার্মেসিতে- যাতে করে জনসাধারণ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সঠিক ওষুধ ফার্মেসি থেকে পান, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারেন। এছাড়া কোনো ওষুধের যেন অপব্যবহার বা ভুল ব্যবহার না হয়, এমনকি কোনো চিকিৎসক যদি রোগীর ক্ষেত্রে উপযুক্ত ওষুধ নির্বাচনে ভুল করেন তাহলে একজন গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট সেটি সংশোধন করতে পারেন। এমনকি চিকিৎসক যদি বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ওষুধ লিখেন সেক্ষেত্রেও শুধু একজন গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট সেটি নির্ণয় করতে পারেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী কমিউনিটি ফার্মেসির পাশাপাশি গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা হাসপাতাল ফার্মেসিতে এবং স্বল্পসংখ্যক ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করবেন। এছাড়া ফার্মাসিস্টদের শতকরা ৫৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মেসি, ৩০ শতাংশ হাসপাতাল ফার্মেসি, ৫ শতাংশ উৎপাদন প্রক্রিয়া (ম্যানুফ্যাকচারিং), ৫ শতাংশ সরকারি সংস্থায় এবং ৫ শতাংশ একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকবেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে কমিউনিটি ফার্মেসি কিংবা হাসপাতাল ফার্মেসিতে কোনো গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। অন্যদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ৮৫ শতাংশ ফার্মাসিস্ট কর্মরত রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আবম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, একটা সময় ছিল যখন দেশে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ফার্মাসিস্ট ছিল না। এখন পর্যাপ্ত ফার্মাসিস্ট থাকলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সেটা করা যাচ্ছে না। যদিও সর্বশেষ ওষুধ নীতিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতে কমিউনিটি পর্যায়ের ফার্মেসিতে অবশ্যই গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি বলেন, কমিউনিটি ফার্মেসি বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা বলতে চেয়েছে বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো ফার্মেসি নেই। তবে এ দেশের সব ফার্মেসিই কমিউনিটির মধ্যে। তবে সেগুলো রিটেইল ফার্মেসি। এ ক্ষেত্রে এসব ফার্মেসির সংস্কার বা পরিবর্তন করা যেতে পারে। কমিউনিটি ফার্মেসি গড়ে তুলতে পারলে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা অবশ্যই সেখানে সেবা দেবেন। যেখানে নির্দিষ্ট কমিউনিটির সব রোগীর ফাইল সংরক্ষণ থাকলে ভুল ওষুধ ব্যবহার বন্ধ হবে। তিনি বলেন, ওষুধের নিরাপদ ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে শুধু কমিউনিটি ফার্মেসিতে নয়, হাসপাতাল ফার্মেসি, মিলিটারি হাসপাতাল ও ফার্মেসি, একাডেমিক ফার্মেসি- সবখানেই গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে কোথাও কোনো কমিউনিটি ফার্মেসিতে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট তো দূরের কথা কোনো ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট বা সি গ্রেডের ফার্মাসিস্টও কাজ করে না। ফলে দিন দিন বাড়ছে ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার। প্রতিরোধী ক্ষমতা হারাচ্ছে এন্টিবায়োটিক। মৃত্যুসঞ্জিবনী ওষুধের অপব্যবহার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। যে যার মতো ওষুধ কিনছে, খাচ্ছে এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধ নেশাদ্রব্য হিসেবেও ব্যবহার করছে। কিন্তু কমিউনিটি পর্যায়ের ফার্মেসিতে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেউ ওষুধ কিনতে পারত না। বন্ধ হতো ওষুধের অপব্যবহার।

জানা গেছে, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ফার্মেসিতে গ্রাজুয়েশন করার পরও উপযুক্ত চাকরি না পেয়ে অনেকে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন। অনেকে আবার বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। দেশে ভালো মানের গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকায় ওষুধ শিল্প দ্রুত উন্নত হচ্ছে। তবে ওষুধ বিপণন ব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র সঠিক রয়েছে কিনা সেটি গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়া অন্যদের পক্ষে নিশ্চিত করা অসম্ভব। আর তাই ফার্মাসিস্টদের সঠিক ব্যবহারের তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটা করতে না পারলে ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে না। সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ১২টি এবং ২২টি প্রাইভেট। পাস করে অধিকাংশ ফার্মাসিস্ট বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে ভালো সুযোগ-সুবিধায় রয়েছেন। এরপরও দেশে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বেকার। কমিউনিটি ও হসপিটাল ফার্মেসিগুলোতে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করা হলে দেশের মানুষ উপকৃত হতো। সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় এবং বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক কম হওয়ায় কমিউনিটি ও হাসপাতাল ফার্মেসিতে কোনো গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কাজ করেন না।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশের ওষুধ বিপণন ব্যবস্থা-জিএমপি (গুড মার্কেটিং প্র্যাকটিস) ঠিক রাখতে পর্যায়ক্রমে সব ফার্মেসি মডেল ফার্মেসিতে রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে। এ পর্যন্ত দেশে ২২৫টি ফার্মেসি মডেল ফার্মেসি হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। বেশ কিছু উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। এসব ফার্মেসিতে একজন গ্রাজুয়েট, ডিপ্লোমা এবং সি ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট রয়েছেন- যাদের ওষুধের সঠিক নিয়ম-কানুন ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালো ধারণা রয়েছে। অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ওষুধের খুচরা ও পাইকারী নিবন্ধিত দোকান রয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার। ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির হিসাব মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ওষুধের দোকান রয়েছে সাড়ে তিন লাখের অধিক।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. একে লুৎফুল কবির যুগান্তরকে বলেন, দেশে বর্তমানে অসংখ্য গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বেকার রয়েছেন, তাদের কাজে লাগাতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে দেশের ওষুধ ফার্মেসি ও হাসপাতাল ফার্মেসিতে তাদের শিক্ষার সঠিক ব্যবহার এবং মূল্যায়নের সুযোগ দেয়া হলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা ওষুধের গুণাগুণ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ডোজেস সম্পর্কে অভিজ্ঞ। তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে এবং বেকারত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে।

সামগ্রিক বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। ইতিমধ্যে মডেল ফার্মেসি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে- যেখানে গ্রাজুয়েট ফার্মসিস্ট থাকার বিধান করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সারা দেশে মডেল ফার্মেসি গড়ে তোলা হবে। এভাবেই ওষুধের নিরাপদ ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/23/174038