২৩ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪০

৯ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে ৭ ব্যাংক

আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়েছে সাতটি ব্যাংক। এর মধ্যে ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকাই তিনটি সরকারি ও বাকি প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা চারটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের। প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি হওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়া সরকারি তিন ব্যাংকের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৪২১ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ৯০১ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। আর বেসরকারি চার ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রায় ১৯৯ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮৬২ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রায় ১৬০ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেসিক ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। এসব ঋণের বেশির ভাগেরই কোনো জামানত নেই। আর জামানত না থাকায় এসব ঋণ ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি অন্যতম হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। সাধারণত ঋণ শ্রেণিকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলোÑ নিম্নমান, সন্দেহজন ও মন্দ বা তি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরণ করতে হয়।
কোনো ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে ঋণের শ্রেণী ভেদে ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থাৎ ব্যাংকটি যে পরিমাণ আয় করে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারায় ঘাটতি দেখা দেয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংকের রিটেইন আর্নিং কমে যায়। এভাবে পরে সমন্বয় করতে না পারলে মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। আর সেই সাথে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয়ও (ইপিএস) কমে যায়। আয় কমে গেলে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন, ব্যবসামন্দা, পুঁজিবাজারে মূল্য পতনের পাশাপাশি আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের এবার পরিচালন মুনাফা কমে গেছে। এর বাইরে হলমার্কসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণকেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে। এতে বেড়ে গেছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। সবমিলে এবার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে গেছে। এর ওপর অতিরিক্ত প্রভিশন রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা না হয়ে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফা কমে যাচ্ছে। তার মধ্যে বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। কেননা এসব ব্যাংকের পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ বেশি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখা হয় ব্যাংকের আয় থেকে। প্রভিশন সংরক্ষণ না করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া যায় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংকের ১১ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ৭ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পেরেছে ৪ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯০১ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৮ কোটি টাকা।

বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৭০৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ৪ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা, সেখানে ব্যাংকটি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পেরেছে মাত্র ১ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা।
তেমনিভাবে ৪ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ২ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পেরেছে অর্ধেক অর্থাৎ ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/270830