২৩ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:১২

সৃজনশীলতার নামে শিক্ষায় ‘হ-য-ব-র-ল’ অবস্থা

সৃজনশীলতার নামে শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘হ-য-ব-র-ল’ অবস্থা বিরাজ করছে। সৃজনশীল পদ্ধতির পাঠদান থেকে শুরু করে প্রশ্নের বিষয় নির্ধারণ ও প্রশ্ন প্রণয়ন সর্বত্রই অদক্ষতা এবং কারসাজি চলছে। স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ছাড়াও জেএসসি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষায় এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আদৌ কিছু শিখছে কিনা তা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। চালুর আট বছর পরও পদ্ধতিটি নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক, এমনকি শিক্ষকদের মাঝেও এক ধরনের 'ভীতি' কাজ করছে। সরকারি প্রতিবেদনেই বলছে, দেশে অর্ধেকের বেশি (৫২.০৫%) মাধ্যমিক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেনই না। আর প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী এখনও সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝে উঠতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তারা কোচিং ও গাইড বই অনুসরণ করছে। সৃজনশীল পাঠদানের মানোন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও সরকারের অর্থায়নে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার এ প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও তাতে কোনো ফল মেলেনি।
দেশে ২০০৯ সাল থেকে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে লেখাপড়া শুরু হয়। শুরুর ৮ বছর পর এসেও বিতর্ক থামছে না। বিতর্ক ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাবিদদের নিয়ে বেশকটি সভাও করেছে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। ফলে পড়াশোনা হয়ে গেছে কোচিং আর গাইডনির্ভর।

গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে হঠাৎ করে সৃজনশীল বিষয়ে নতুন ঘোষণা জারির পর সারা দেশের এসএসসি ও এইচএসসির শিক্ষার্থী অভিভাবকেরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। নতুন ঘোষণায় তখন বলা হয়, ছয়টির স্থলে সাতটি সৃজনশীল প্রশ্ন লিখতে হবে শিক্ষার্থীদের। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা তখন জানিয়েছিল নির্ধারিত সময়ে তারা ছয়টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরই লিখে শেষ করতে পারে না। সেখানে নতুন আরেকটি প্রশ্ন বাড়িয়ে সময় বাড়ানো হয়েছে মাত্র ১০ মিনিট। মোট আড়াই ঘণ্টা সময়ে কিছুতেই সাতটি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখা সম্ভব নয় বলে জানায় শিক্ষার্থীরা। তা ছাড়া পরীক্ষার অল্প আগে এ ধরনের ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয় শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা সময় স্বল্পতার কারণে সৃজনশীল প্রশ্ন লিখে শেষ করতে পারেনি। সাতটি প্রশ্ন বলা হলেও আসলে প্রত্যেকটি প্রশ্নের অধীনে আবার ক, খ, গ, ঘ সহ অনেক প্রশ্ন ও শাখা প্রশাখা রয়েছে। তাই ফল খারাপের জন্য অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি এবং সৃজনশীলের জন্য বরাদ্দকৃত অপর্যাপ্ত সময়কে দায়ী করেছেন এবার। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর নতুন ঘোষণার পর সৃজনশীল নিয়ে শিক্ষার্থীরা তখন যেসব উদ্বেগ আতঙ্কের কথা জানিয়েছিল তা একেবারেই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে।
এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ২৬টি বিষয়ে ৫০টি পত্রের সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়। গত বছর ১৯টি বিষয়ের ৩৬টি পত্রের সৃজনশীল পরীক্ষা হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে বিষয় বেড়েছে ৭টি ও পত্র বেড়েছে ১৪টি।

জানা গেছে, মুখস্থবিদ্যা পরিহার করার লক্ষ্যে মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, এই পদ্ধতিতে নোট-গাইড বই থাকবে না, কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন নাম পরিবর্তন করে নোট-গাইড বইয়ের জায়গায় অনুশীলন বা সহায়ক বই চলছে। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা বলছেন, শিক্ষকেরাই বিষয়টি ভালোভাবে না বোঝায় শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেট বা সহায়ক বইয়ের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
সৃজনশীলে একটি বিষয়কে চারটি ভাগে প্রশ্ন করা হয়। এতে প্রথম অংশের প্রশ্নের উত্তর বই থেকে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও বাকি তিনটি অংশের উত্তর দেয়ার কথা বুদ্ধি খাটিয়ে। বাস্তবে এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া তো দূরের কথা বরং বিপরীতটিই ঘটতে দেখা যাচ্ছে বেশি করে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কারণে কোচিং ও গাইডনির্ভরতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো বেড়ে গেছে। যে কারণে গাইড বই এবং কোচিং ব্যবসার এখন রমরমা অবস্থা। এমনকি শিক্ষকদের কেউ কেউ নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে ক্লাসে পাঠদান এবং প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গাইড বই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে গণিত এবং ইংরেজি বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি বহালের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কোনো কোনো শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ। শিক্ষার্থীদের বড় অংশের কাছে দীর্ঘদিন ধরে এই দু’টি বিষয় আতঙ্কের কারণ হয়ে রয়েছে। তার ওপর সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন আরো হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
সৃজনশীল পাঠদানের মানোন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও সরকারের অর্থায়নে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (এসইএসডিপি) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী এখনও সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝে উঠতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তারা কোচিং ও গাইড বই অনুসরণ করছে। আর অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল না বুঝেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন।

আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হয়েছে ৭৫২ কোটি টাকার বেশি। আর বরাদ্দ ছিল ৭৯৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ, মোট বরাদ্দের প্রায় ৫ শতাংশ ব্যয় করা যায়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, সৃজনশীল পদ্ধতির চারটি ধাপ- জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক বিষয়ের ওপর প্রশ্নের কিছু উত্তর দিতে পারলেও প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতামূলক উত্তর দিতে পারেনি। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা গণিতের ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ, ইংরেজির ৮ দশমিক ২ ও বিজ্ঞানের ৩৩ শতাংশ বিষয় কঠিন বলে মনে করেছে।
বিভিন্ন বর্ষের পাবলিক পরীক্ষার ফল বিশ্নেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ ও ২০১৭ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার মূল কারণ গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিতে কম নম্বর পাওয়া। ফলে ওই বিষয়গুলো বুঝতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশকে প্রাইভেট পড়তে হয় ও গাইড বই অনুসরণ করতে হয়, যা স্থানীয় পর্যায়ে মতবিনিময় কর্মশালায় উপস্থিত শিক্ষার্থীরাও বলেছে। শিক্ষার্থীদের মতে, শিক্ষকদের প্রায় ৪০ শতাংশ তাদের প্রাইভেট পড়তে উৎসাহিত করেন।
আরও বলা হয়, পাঠ্যক্রম ও সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সময় যথেষ্ট ছিল না। পরিবর্তিত পাঠ্যক্রম শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা কমাতে পারেনি, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের ভাষা কঠিন ছিল। শিক্ষকরা প্রশ্ন প্রণয়ন ও পাঠদানে সরাসরি গাইড বই ব্যবহার করছেন। সৃজনশীল পদ্ধতি সঠিকভাবে না বোঝার কারণে এখনও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কোচিং ও প্রাইভেট পড়ছে। স্থানীয় কর্মশালায় নির্বাচিত স্কুলের কোনো শিক্ষকই সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ পাননি। প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে অর্ধেকের বেশি (৫২.০৫%) মাধ্যমিক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেনই না। গত মে মাসে ১৮ হাজার ৫৯৮টি মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শন করে মাউশি এ প্রতিবেদন দেয়। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে এ ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছে। যার সবগুলোকে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষজনক প্রতিবেদন দিয়েছে।
পদ্ধতি না বোঝায় অনেক শিক্ষক তা মানছেন না। বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা নেন। স্কুল-কলেজ তো বটেই, খোদ বোর্ড পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। শিক্ষার্থীরা আগে এক কোম্পানির গাইড কিনলেও এখন বেশি উদ্দীপক পাওয়ার আশায় একাধিক কোম্পানির গাইড কিনছে। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ক্লাসরুমের পরিবর্তে চলে গেছে কোচিং সেন্টারে। শিক্ষকরা এ পদ্ধতি না বোঝায় কমার্শিয়াল কোচিং সেন্টার বিস্তার লাভ করেছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসাও বেড়েছে।
মাউশি দেশের শিক্ষা প্রশাসনের নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে সর্বশেষ গত মে মাসে ৬ হাজার ৬৭৬টি বিদ্যালয় (মোট বিদ্যালয়ের প্রায় ৩৬ শতাংশ) সুপারভিশন করে প্রতিবেদনটি করেছে। আর গত বছর ৬ হাজার ৪৪২টি বিদ্যালয় সুপারভিশন করা হয়েছিল। বর্তমানে সারা দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ১৮ হাজার ৫৯৮টি। এসব বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী এক কোটির বেশি।
মাউশির সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সুপারভিশন করা বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। বাকি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় বা বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে কাজ চালান। এর মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় ও ২১ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, একটা পদ্ধতি থেকে আরেকটি পদ্ধতিতে যাওয়ার জন্য কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। সরকার সেই প্রস্তুতি না নিয়েই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করে। এতে শিক্ষকরা প্রথম থেকেই কোচিং ও গাইড বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। একপর্যায়ে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়েছে। এখন গাইড ও কোচিংকে বৈধতা দেয়া হলে শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠ্যবই না পড়িয়ে গাইড বই ও কোচিং করতে কোনো বাধা থাকবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গত কয়েক বছর ক্লাসে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোই হয়েছে শিক্ষার্থীদের চাপে রাখা জন্য। এতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় কোচিং বা গাইড বই পড়তে। তাহলে সৃজনশীল পদ্ধতি বা স্কুলের দরকার কি? সবার আগে শিক্ষার দর্শন ঠিক করার পরামর্শ দেন তিনি। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালুর বিষয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে কিছু ব্যক্তি কিছু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শন করে এসে এটা চালু করেন। কিন্তু যে দেশে ৮০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ নেই- সেখানে মাল্টিমিডিয়া দিয়ে খুব একটা লাভ নেই। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

http://www.dailysangram.com/post/308717