২৩ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:১০

মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না

সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল সারা দেশে। কিন্তু আগুন কে লাগালো- এমন প্রশ্নে লক্ষ্য করা গিয়েছিল ব্লেম গেম। কিন্তু এখন সত্য স্পষ্ট হয়েছে। এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারী হিসেবে ২৯ জনকে চিহ্নিত করেছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। এদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। বাকিরাও সরকারি দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাদের সবার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসে আগুন দেয়া হয়। এতে ৪২টি কক্ষ ভস্মীভূত হয়। ঘটনার পাঁচ বছর পর গত বুধবার (১৫/১১/১৭) সিলেটের মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদনের শুনানি শেষে সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম উম্মে সরাবন তহুরা দায়ী ২৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

পাঁচ বছর আগে ছাত্রাবাসটি পোড়ানোর ঘটনায় দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ছাত্রাবাসটি দেশে-বিদেশে ‘হেরিটেজ’ হিসেবে সমাদৃত হতো। অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার জন্য ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে ছাত্রলীগ। আর ছাত্রশিবির অভিযোগ করে, ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের তাড়াতে ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয়। ছাত্রাবাস যখন আগুনে পুড়ছিল তখন পাশ দিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করছিল। এই নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল প্রথম আলোয়। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘বিক্ষোভকারীরাই আগুন দিয়েছে ছাত্রাবাসে!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

ঐতিহ্যবাহী একটি কলেজের হেরিটেজ খ্যাত ছাত্রাবাসে ছাত্রনেতারা আগুন দেয় কেমন করে? এমন হিংসা, বিদ্বেষ ও নিষ্ঠুরতা যারা অন্তরে পোষণ করে তারা ছাত্রনেতা হয় কেমন করে? অথচ বর্তমান সময়ে এমন বৈশিষ্ট্যের ছাত্ররাই ছাত্রনেতা হয়ে যায় সহজেই। আর সরকারি দলের সাথে যুক্ত থাকায় নানা প্রশ্রয়ে তারা হয়ে ওঠে বেপরোয়া। আলোচ্য ঘটনায় অগ্নিসংযোগকারী সনাক্ত করতে শাহপরান থানার পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দুই দফা তদন্তের পর সর্বশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধিকতর তদন্ত করে। পিবিআই তদন্ত শেষে গত ৩১ মে সন্দেহভাজন অগ্নিসংযোগকারীদের (ছাত্রলীগের নেতা) বিরুদ্ধে প্রমাণ না পেয়ে তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের শুনানি শেষে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিচার বিভাগীয় তদন্তের ফলে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হলো এবং জানা গেল যে, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী। অথচ পুলিশের প্রতিবেদনে তো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছিল। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিলে তো তারা প্রশ্রয় পেতো, হয়তো আরো বেপরোয়া হয়ে নানা অপরাধ করে বেড়াতো। বর্তমান সময়ে প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রলীগ নেতাদের অপরাধের যে সব খবর পত্রিকায় মুদ্রিত হচ্ছে তার বড় কারণ কিন্তু এই প্রশ্রয়। দেশের পুলিশ, প্রশাসন এবং সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখলে ভাল হয়।
উল্লেখ্য যে, শুধু দেশে নয়-ন্যায়ের অভাবে, নীতির অভাবে সারা পৃথিবীতেই অরাজকতার এবং দাপটের একটা চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর ফলাফল কিন্তু সবসময় সুখকর হয় না।

জিম্বাবুয়ের ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসের সেই সত্যকেই যেন আবার উচ্চারণ করলো। দেশটির প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের পদত্যাগের দাবিতে ১৮ নবেম্বর জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। বিবিসির খবরে বলা হয়, জনতার সমাবেশ উৎসবে রূপ নেয়। তারা মুগাবের শাসন অবসানে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে। সমাবেশে যোগদানকারী জনতাকে সেনাদের জড়িয়ে ধরতেও দেখা যায়। উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন দল জানু পার্টি এ সমাবেশের আয়োজন করে। গত বছরও যেসব প্রবীণ স্বাধীনতা যোদ্ধা মুগাবের অনুগত ছিলেন, তারাও এখন বলছেনÑ মুগাবের ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া উচিত। হারারে থেকে বিবিসি প্রতিনিধি আরো বলেছেন, এটি পানি সিঞ্চনের সময় এবং মুগাবের আর ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা নেই। মানুষ বলছে, এখন আমাদের নতুন অভিযাত্রা। আমরা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান চাই এবং জিম্বাবুয়েকে আর পেছনের দিকে ঠেলে দিতে চাই না।

ভাবতে গেলে অবাক লাগে, জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা যুদ্ধের গেরিলা নেতা মুগাবে এমন দুঃখজনক পরিস্থিতিতে পতিত হলেন কেন? এর বিশ্লেষণও হচ্ছে। ফার্স্ট লেডি গ্রেস মুগাবের উচ্চাভিলাষী ও আগ্রাসী স্বভাবের কারণেই জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের পতন হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত বুধবার দেশটির ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। শপিংয়ে প্রচুর অর্থ খরচ করার বদনাম রয়েছে গ্রেস মুগাবের। ভ্রমণসহ সবকিছুতেই তার বিলাসী জীবন। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পোশাক, প্রসাধনী, বিলাসবহুল হোটেল ও বিমান ছাড়া চলতো না তার। যার সবকিছুই মেটানো হতো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন কাজে অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া মুগাবের চেয়ে বয়সে ৪১ বছরের ছোট গ্রেসের সম্প্রতি নজর পড়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট পদের দিকে। স্বামী মুগাবের ওপর তার প্রবল প্রভাব। এমনকি মুগাবেকে সরিয়ে এই পদে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। এটিই জিম্বাবুয়ের সর্বশেষ সংকটের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া গত সপ্তাহেই ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়াকে বরখাস্ত করে গ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ সুগম করেন বরার্ট মুগাবে। এসব দেখে সেনাবাহিনী ভেবেছে, এমনটি আর চলতে দেয়া যায় না।

মানুষের আচরণ কত বিচিত্র! মুগাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। গেরিলা নেতা ছিলেন। মানুষ তার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কিন্তু নীতিভ্রষ্ট হওয়ার কারণে মানুষ আজ তাকে স্বৈরশাসক হিসেবে অভিহিত করছে। তাকে আর শাসক হিসেবে দেখতে চায় না। অবশ্য তার এই পতনে উচ্চাভিলাষী স্ত্রীর দায়ও কম নয়। ইতিহাসে এমন পতনের আরো বহু উদাহরণ আছে। তবে ট্র্যাজেডি হলো, মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চায় না।

http://www.dailysangram.com/post/308623