২২ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৩১

সাইবার ক্রাইম বাড়ছে বেশিরভাগ ফেসবুককেন্দ্রিক

বাড়ছে সাইবার ক্রাইম। প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। ৯৫ ভাগ অভিযোগই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুককে কেন্দ্র করে। ফেসবুকে প্রেম, ভালোবাসা। তারপর শারীরিক সম্পর্ক। একপর্যায়ে ব্ল্যাকমেইল।
হুমকি-ধমকি। এক্ষেত্রে ভিকটিমের বেশিরভাগই নারী। সাধারণত এক শ্রেণির প্রতারকের শিকার হন সরল মনের নারীরা। সাইবার ক্রাইমের অভিযোগের পাল্লা ভারি হলেও মামলা হচ্ছে এর ৩০ ভাগ। সামাজিক নানা কারণে মামলা থেকে দূরে থাকতে চায় ভুক্তভোগীরা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে সাইবার আইনে মামলা হয়েছে ৬২৭টি। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা প্রায় ৭০০ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। দিন দিন সাইবার ক্রাইম বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে মামলার সংখ্যা।
২০১৪ সালে সাইবার আইনে মামলা হয়েছিল ১১৫। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৬। ২০১৬ সালে ৬৬০
। সাইবার ক্রাইমের অন্তত ১২টি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সাইবার হয়রানি। এতে রয়েছে ই-মেইল, ব্লগ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে হুমকি-ধমকি, ব্যক্তির নামে মিথ্যাচার বা অপপ্রচার, নারী অবমাননা, যৌন হয়রানি। এছাড়াও ব্যক্তিগত তথ্য-পরিচয়-ছবি চুরি, হ্যাকিং, অর্থ আত্মসাৎ ও পর্নোগ্রাফি এবং মেলওয়্যার স্পার্মিংয়ের অভিযোগের সংখ্যাও কম না। সাইবার ক্রাইম বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখেই গত বছরের মে মাসে যাত্রা শুরু করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম বিভাগ। এই ইউনিটের পুলিশ কর্মকর্তারা নানাভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সাইবার ক্রাইমের শিকার ব্যক্তিদের। সামাজিক কারণে মামলা না করেও সেবা নিচ্ছেন অনেকে। ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ রয়েছে পাঁচ শতাধিক। এরমধ্যে তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ৯৬টি।

সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আলীমুজ্জামান বলেন, অনেক অভিযোগ আসে। অভিযোগের ৯৫ ভাগই ফেসবুককেন্দ্রিক প্রেম-ভালোবাসা থেকে হুমকি-ধমকি, ব্ল্যাকমেইল। এক্ষেত্রে বিকাশে অর্থ আদায়ের ঘটনাও ঘটে। অভিযোগ পেলে আমরা দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। ভিকটিমের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই তদন্ত করা হয় বলে জানান তিনি।
সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যান। নিজের গোপন দুর্বল বিষয়গুলো মানুষ জেনে যাবে- এমনটি ভেবে কোনো উপায় খুঁজে পান না। এরকম জটিল পরিস্থিতি থেকে ভুক্তভোগীদের উদ্ধার করছে সাইবার ক্রাইম ইউনিট। তাদের একজন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসিন্দা। তিনি একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। ওই ছাত্রী জানান, ২০১২ সালে মোখলেছুর রহমান নামে বুয়েটের এক ছাত্রের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয়। এরপর তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। এলিফ্যান্ট রোডের আমতলার একটি বাসায় প্রায়ই ঘনিষ্ঠ সময় কাটাতেন এই জুটি। এমনকি লালবাগ থানা এলাকার একটি বাসায় মেডিকেলের ওই ছাত্রীকে নিয়ে যেতো ছেলেটি। ওই সময়ে দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অনেক ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করে মোখলেছুর। মেডিকেলের ওই ছাত্রী দাবি করেন, বিয়ের প্রলোভন দিয়েই তার সঙ্গে এরকম সম্পর্ক তৈরি করে ছেলেটি। শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করে নানা রকম টালবাহানা করতে থাকে। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিতেই ঘটে বিপত্তি। একের পর এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওচিত্র, ছবি পাঠানো হয় ওই ছাত্রীর ফেসবুকের ইনবক্সে, হোয়াটসঅ্যাপে। ভুক্তভোগী ছাত্রী জানান, আমাকে বাদ দিয়ে অন্য এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এসব বিষয়ে কথা বলতেই সোস্যাল মিডিয়ায় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি, ভিডিও আপলোড করে আমার মর্যাদাহানি করবে বলে হুমকি দিচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত মেডিকেলের ওই ছাত্রী থানা-পুলিশমুখো হন। গ্রেপ্তার করা হয় মোখলেছুরকে।

এরকম অভিযোগ অনেক। ফেসবুকে পরিচয়, প্রেম থেকে শারীরিক সম্পর্কের ফলে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন এক নারী। তিনি রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা। দুই সন্তানের জননী। তার স্বামী ব্যবসায়ী। ব্যবসার প্রয়োজনে থাকেন পটুয়াখালীতে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এই নারীর ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিলো শাহরিয়ার আহমেদ নামে এক যুবকের সঙ্গে। চ্যাট করতে করতে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান তারা। সরাসরি সাক্ষাতের প্রথমদিনই উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর সড়কের বাসায় ডেকে নেন সাঈদকে। বাসায় সেদিন একা। স্বামী পটুয়াখালী। দুই মেয়ে স্কুলে। এভাবে প্রায়ই বাসায় মিলিত হন তারা। কিন্তু রমজান মাসে স্বামী ঢাকায় থাকায় বাইরে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে সময় কাটাতেন শাহরিয়ারের সঙ্গে। তবে স্ত্রীর অন্যমনস্কতা টের পান স্বামী। বাকবিতণ্ডা হয়। কলহ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শাহরিয়ারের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন ওই নারী। ঠিক তখনই ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে শাহরিয়ার। যে কোনো মূল্যে সম্পর্ক ধরে রাখতে চায় সে। অন্তরঙ্গ ছবিগুলো প্রকাশের হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে ফেসবুকে পোস্ট করে দেয় তা। আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজনদের কাছে মুখ দেখাতে পারছিলেন না ওই নারী। সারাক্ষণ কাটতো বাসায়। সংসার ভাঙে প্রায়। একপর্যায়ে নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। শাহরিয়ারকে ফোনে বলেছিলেন, ‘দোহাই আমাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করো না।’ তাতেও থামেনি শাহরিয়ার। বরং এবার ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিতে থাকে। যা গোপনে হোটেলকক্ষে ধারণ করেছিলো সে। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে মামলা করা হয় উত্তরা পূর্ব থানায়। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। গ্রেপ্তার করা হয় শাহরিয়ারকে। উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও। এভাবেই ওই নারীকে রক্ষা করা হয় দুর্বৃত্তের কবল থেকে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি সাইবার অপরাধ কমাতে হলে সকলকে সচেতন হতে হবে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=93138