২২ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৩০

ফাঁদে ফেলে চাঁদাবাজি

নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচ হলো আইন। কারো অধিকার লঙ্ঘন হলে অভিযোগ বা মামলার পর আইনের যথাযথ প্রয়োগে তার প্রতিকার বিধান করে। কিন্তু আইনের অপব্যবহার করে মামলা বা অভিযোগকেই এখন চাঁদাবাজি ও হয়রানির ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে দুর্বৃত্তরা। হয়রানি করতে দায়ের হচ্ছে মিথ্যা মামলা বা ভুয়া অভিযোগ। ফৌজদারি কার্যবিধি থেকে শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন। প্রায় সব আইনের ক্ষেত্রেই ঘটছে এমন ঘটনা।
এতে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর মিরপুর শপিং সেন্টার। এখানে মোবাইল ও কম্পিউটারের ব্যবসা করেন মো. লিটন। দোকানের নাম ‘উইন্টাল মোবাইল অ্যান্ড কম্পিউটার’। গত অক্টোবরের শুরুতে সেখান থেকে একটি মোবাইল (এমআই নোট ৪ এক্স) কেনেন এসএম মেহেদী হাসান (২২) নামে এক যুবক। এরপর গত ১৫ই অক্টোবর ওই মোবাইল ফোন সেট নকল বলে দাবি করেন মেহেদী। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’-এ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন দোকানদার লিটনের বিরুদ্ধে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় অভিযোগ গ্রহণ করে। দেয়া হয় শুনানির তারিখ। পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয় গত ৮ই নভেম্বর। উভয় পক্ষকে নিজ নিজ পক্ষে তথ্য-প্রমাণ নিয়ে হাজির হতে বলা হয় প্রতিষ্ঠানটির কাওরান বাজারের প্রধান কার্যালয়ে।

কিন্তু এর আগেই স্বয়ং অভিযোগকারী মেহেদী দোকানদার লিটনের কাছে অভিযোগে দণ্ডের ভয় দেখিয়ে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে। দীর্ঘ দরকষাকষিতে দফারফা হয় ৩০ হাজার টাকায়। কিন্তু দোকান থেকে গ্রহণ নয়। টাকা নিয়ে মেহেদীর প্রস্তাবিত একটি হোটেলেই যেতে বলা হয়। তার সঙ্গে যায় মো. মিলন (২৫) ও মো. কুতুব উদ্দিন (২৭) নামে আরো দু’সহযোগী। গত ৬ই অক্টোবর মিরপুর ন্যাশনাল হোটেলে খাওয়া-দাওয়ার পর লিটনের কাছ থেকে গ্রহণ করে চাঁদার ৩০ হাজার টাকা। টাকা নিয়ে বের হতেই ঘুষের টাকাসহ মেহেদী, মিলন ও কুতুবকে গ্রেপ্তার করে মিরপুর থানা পুলিশ। এখন তিনজনই কারাবন্দি।
মিরপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বজলার রহমান মানবজমিনকে বলেন, অভিযোগ বা মামলার ফাঁদে ফেলে জিম্মি করে চাঁদা আদায়ের খবর পেয়ে লেনদেনের কাছাকাছি স্থানে অপেক্ষা করছিলাম। চাঁদার টাকাসহ তিনজনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে মামলাকে ব্যবহার করে থানায়ই এমন হয়রানি বেশি হয় বলে জানিয়েছেন ওই থানার অপর এক কর্মকর্তা।
ভোক্তা অধিকারে দাখিল করা অভিযোগটি তদারকির দায়িত্বে থাকা জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রজবী নাহার রজনী বলেন, প্রমাণ নিয়ে হাজিরের শুনানির আগের দিনই অভিযোগকারী এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে শুনেছি।

এর আগে গত জুলাইয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে সংশ্লিষ্ট আইনে একটি অভিযোগ করেন নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটির ছাত্র সাগর মিয়া। যমুনা ফিউচার পার্কের ব্ল্যাক বাস্টার মুভিজের ফাস্ট ফুডের দোকান মানচিজ-টু’তে কোমলপানীয় কোকাকোলার দাম বেশি রাখার অভিযোগ। এরপর তিনি তার কেনা ওই পণ্যের রসিদ ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। তা কপি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ থেকে পাস করা আবদুল্লাহ আল মানসুর। তিনি এখন একটি প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মরত। গত ১৮ই জুলাই মানসুর স্ক্যান করে আপলোড করা রসিদের ওই কপি নিয়ে নিজেই ভোক্তা দাবি করে ই-মেইলে একটি অভিযোগ করেন। অভিযোগ নম্বর এনসিসিসি ৬৮২৮। একটি রসিদের কপি ব্যবহার করে তিনি ডাকযোগে আরো একটি অভিযোগ দাখিল করেন। সেই অভিযোগ নম্বর এনসিসিসি ৬৮৮৮। কিন্তু দু’টি অভিযোগই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রজবী নাহার রজনীর হাতে গিয়ে পড়ে। প্রকৃত অভিযোগকারীর অভিযোগটিও তার হাতে পড়ায় পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়। ফলে তিনি প্রতারক অভিযোগকারী মানসুরকে করেন ৫ হাজার টাকা জরিমানা। অন্যদিকে, অভিযোগের সত্যতা থাকলেও রসিদ ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার পর অপব্যবহার হওয়ায় সাগর মিয়ার অভিযোগটিও খারিজ করে দেয়া হয়।

এ ধরনের মামলা তদারক করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফাহমিদা আক্তার। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে অসৎ উদ্দেশ্যে করা কিছু অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন দু’একটি অভিযোগ ব্যবহার করে চাঁদাবাজিও হচ্ছে। এর আগে গত মার্চে মিরপুরের হাজীর বিরিয়ানি নামে এক রেস্টুরেন্টে কোমলপানীয়ের দাম বেশি রাখার অভিযোগ আনেন নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটির আরেক ছাত্র। কিন্তু অভিযোগটি প্রমাণিত হওয়ার আগেই সেই অভিযোগ আর না চালানোর প্রস্তাব দিয়ে তার বাড়ির ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের জন্য ৬টা মোরগ পোলাও ঘুষ চেয়ে বসেন ওই ছাত্র। আর তার এ ঘুষ চাওয়ার কথা মোবাইলে ধারণ করেন দোকানদার।

জানা যায়, ২০১০ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে চলতি বছরের ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৮ বছরে ১০ হাজার ৬৪৮টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ২২৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। তদন্তাধীন রয়েছে ৪২০টি অভিযোগ। দাখিল হওয়া সাড়ে ১০ হাজার মামলার অন্তত ৭০ ভাগ মামলা সঠিক থাকলেও ৩০ ভাগ অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি। এর মধ্যে বেশকিছু মামলায় অসৎ উদ্দেশ্যসহ চাঁদাবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কেবল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে নয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ আইনি সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠানে, থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে শাস্তির ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর মানবজমিনকে বলেন, এখানে অভিযোগ দায়েরের পর তা ব্যবহার করে অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু চাঁদাবাজির খবর শোনা যাচ্ছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু অসত্য অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। তবে বেশিরভাগ অভিযোগই সঠিক। যদিও কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণের অভাবে তা প্রমাণিত হচ্ছে না। তবে পুরো বিষয়টি নিয়েই তারা সজাগ রয়েছেন বলেও জানান তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=93056