২২ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২৯

যেভাবে পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতি করে চক্র

প্রশ্ন নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই! যেকোনো প্রশ্নের উত্তরই মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যাবে পরীক্ষার্থীর কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষা। এই চক্রের সদস্যরা সহজেই পরীক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দিতে পারে। এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে অনেক পরীক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। চক্রের দুই হোতাসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। হোতারা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাভিদ আনজুম তনয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী এনামুল হক আকাশ।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, চক্রটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি এমনকি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতি করে। পরীক্ষায় জালিয়াতির জন্য মাস্টারকার্ডের মতো পাতলা এক ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করে। এই কার্ডের মধ্যে থাকে মোবাইলফোনের সিম। পরীক্ষার হলে থাকা পরীক্ষার্থীর কানে থাকে অতি ক্ষুদ্র লিসেনিং কিট। এই ডিভাইসের মাধ্যমে বাইরে থেকে হলের ভেতরে পরীক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে উত্তর বলে দেয় চক্রের সদস্যরা।

এভাবে পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নপত্রটি হলের বাইরে থাকা চক্রের সদস্যদের হাতে পৌঁছে যায়। আগে থেকেই বাইরে প্রস্তুত থাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা। তারা দ্রুত প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করে ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেন। এই চক্রের রয়েছে একটি অনলাইন গ্রুপ। এই গ্রুপে চ্যাটের মাধ্যমেও প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়। এভাবে নানা পদ্ধতিতে দেয়া হয় প্রশ্নের উত্তর। প্রতি পরীক্ষার্থীকে এই অবৈধ সহযোগিতা দেয়ার মাধ্যমে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেয় চক্র। ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন পরীক্ষায় এই চক্রের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা এই ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র।

এ বিষয়ে সিআইডি’র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মিনহাজুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় আরো অনেকে জড়িত রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা অব্যাহত আছে। তিনি জানান, ২০শে অক্টোবর ঢাবি’র ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অমর একুশে হল ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে অভিযান চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মহীউদ্দিন রানা ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়।
আদালতে এই দু’জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ডিজিটাল ডিভাইস সরবরাহ এবং প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার মূল হোতা হিসাবে নাভিদ আনজুম তনয়সহ বেশ কয়েকজনের নাম উঠে আসে। পরে স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে ১লা নভেম্বর আগারগাঁও থেকে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিকে আটক করা হয়। নাফির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৩রা নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের আরেক হোতা আনিনকে। খবর পেয়ে গা-ঢাকা দেয় তনয়। প্রযুক্তির সহায়তায় এবং গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ১৪ই নভেম্বর রংপুরের কামাল কাছনা বাজার এলাকা থেকে তনয়কে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে ডিজিটাল জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসে। ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিনব সব উপায়ের কথা সে সিআইডিকে জানিয়েছে।

তনয় জানিয়েছে, ২০১৫ সাল এবং ২০১৬ সালে টাকার বিনিময়ে ডিজিটাল ডিভাইস এবং পরীক্ষার আগে কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে অবৈধ উপায়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সহায়তা করেছে। তনয়ের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়।
এরপর ঢাবি’র ভিসির অনুমতি নিয়ে প্রক্টোরিয়াল টিমের সহায়তায় ওইসব অবৈধ উপায়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাত জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন- তানভীর আহমেদ মল্লিক, বায়জিদ, নাহিদ ইফতেখার, ফারদিন আহমেদ সাব্বির, প্রসেনজিৎ দাস, রিফাত হোসাইন এবং আজিজুল হাকিম। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম’র বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মিনহাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আসলাম উদ্দিন, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম এবং সহকারী পুলিশ সুপার সুমন কুমার দাসের নেতৃত্বে এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালাচ্ছে সিআইডি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=93132