২২ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২৭

লাগামহীন খেলাপি ঋণ

ঋণ দিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক। দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ, যা লাগামহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বড় ঋণ আদায়ের হার খুবই সামান্য। আবার অনেকে আদালতের আদেশে খেলাপি থেকে নিজেকে বিরত রাখার সুযোগ পাচ্ছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপিরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক।

ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব, সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কম থাকার কারণেই মূলত ঋণখেলাপির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করায় সেখানেও খেলাপির সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (মার্চ-জুন) ৭৩৯ কোটি টাকা এবং তৃতীয় প্রান্তিকে (জুন-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ঋণ অবলোপন করা ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণ অবলোপন হল পাঁচ বছরের পুরনো খেলাপি ঋণ, যা আদায় হচ্ছে না; তার বিপরীতে একটি মামলা ও শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রেখে মূল খাতা থেকে বাদ দেয়া।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর শেষ কোথায়, কারও জানা নেই। সরকারি ব্যাংকে ব্যাপক ঋণ অনিয়মের পর এবার বেসরকারি ব্যাংকেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। ফলে খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা প্রকাশ পাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, খেলাপির সাগরে ভাসছে ব্যাংকিং খাত। বিগত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ দেয়া সব এমডি-পরিচালনা পর্ষদের সদস্য দুর্নীতিবাজ ছিল। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা ঋণ দিয়েছিল। সেসব ঋণ বর্তমানে খেলাপি হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে সরকারি ব্যাংকের এমডিরা যথেষ্ট ভালো। তারা চেষ্টা করছে খেলাপি সংকট কাটিয়ে তুলতে। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের চারজন এবং টানা ৯ বছর থাকার বিধান যদি চালু হয় তবে ব্যাংকিং খাত শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। গত জুনে ঋণ বিতরণ ছিল ৭ লাখ ৩১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে সরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। গড়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি। জুনের তুলনায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ।

তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি খাতের দেশীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ ঋণই খেলাপি। জুনের তুলনায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সে কারণে খেলাপি ঋণ না কমে কেবল বেড়েই চলেছে। এছাড়া যাচাই-বাছাই ছাড়া যেসব নতুন ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেগুলোও খেলাপিতে যোগ হচ্ছে। তিনি বলেন, ঋণ অবলোপনের প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক হলেও এতে কিছুটা খারাপ বার্তা আছে। কারণ অনেকে মনে করেন, ঋণ অবলোপন করলে সে টাকা আর ফেরত দিতে হবে না। তারই প্রমাণ হচ্ছে অবলোপন থেকে আদায়ের পরিমাণ খুবই কম। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। সে ঋণগুলো আবার খেলাপি হচ্ছে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে ভালো ব্যবসায়ীও খেলাপি হচ্ছেন। অবশ্য তার জন্য ব্যবসার পরিবেশ না থাকাকে দায়ী করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন অনেক ব্যবসায়ী।

তথ্যে আরও দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হয়েছে ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি। একইভাবে সেপ্টেম্বরে কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি।

জানতে চাইলে ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন- অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান যুগান্তরকে বলেন, ব্যবসায়িক পরিবেশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। সে কারণে ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। এছাড়া বড় যেসব ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল, তার কয়েকটি খেলাপি হয়ে পড়েছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে। তবে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

 

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/22/173735