২২ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২৬

৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

দেশে আমদানি করা মোবাইল হ্যান্ডসেটের ২৫ শতাংশই আসছে অবৈধ পথে। নি¤œমানের ও নকল এসব হ্যান্ডসেট কিনে নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকেরা। আর এসব হ্যান্ডসেট আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্য দিকে অবৈধভাবে আমদানি করা এসব হ্যান্ডসেটের কারণে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া নকল ও অবৈধ পথে আমদানিকারকদের দাপটে বৈধপথে আমদানিকারকেরাও সেট আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সে জন্য সেট আমদানিতে শুল্ক হার কমানো, ছাড়পত্র নিতে হয়রানি বন্ধ এবং নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি জোরদারের দাবি জানিয়েছেন আমদানিকারকেরা।

বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও আমদানি বাড়ছে। গত বছরই প্রায় তিন কোটি ১০ লাখ মোবাইল ফোন আমদানি হয়েছে। এ বছর এরই মধ্যে সেই পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে। মোবাইল হ্যান্ডসেট ও বেতার যন্ত্রপাতি আমদানি করার জন্য ৮৫০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানকে রেডিও ইক্যুইপমেন্ট ইম্পোর্টার ও ভেন্ডর এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট দিয়েছে কমিশন। এসব প্রতিষ্ঠানকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ কোটি মোবাইল ফোন আমদানির অনাপত্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরও থামছে না অবৈধভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানি। দেশে বর্তমানে আমদানি করা হ্যান্ডসেটগুলোর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ হ্যান্ডসেটই অবৈধভাবে আমদানি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।

বিটিআরসি ও শুল্ক বিভাগের তথ্য মতে, বছরে গড়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার সেট আমদানি হচ্ছে। কিন্তু অবৈধভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানির কারণে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। যার পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। অন্য দিকে বৈধ আমদানিকারকেরা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আর্থিক ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন। ভোক্তারাও নকল ও নি¤œমানের হ্যান্ডসেট কেনার মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন। এসব সেটের মাধ্যমে ক্রমেই বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ ছাড়া অবৈধভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানির কারণে ভুয়া/ডুপ্লিকেট আইএমইআই সম্পন্ন সেট ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এতে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
সূত্র জানায়, রাজস্ব সুরক্ষার স্বার্থে অবৈধভাবে আমদানি করা হ্যান্ডসেটের ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসিকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। একইভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে বিভিন্ন মোবাইল ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান এবং তাদের অ্যাসোসিয়েশন হতে আবেদনও জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী একজন যাত্রী সাথে করে একটি বা দু’টি ফোন ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য শুল্কমুক্তভাবে নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু একটি চক্র এই সুযোগটি নিচ্ছে। এই চক্রটি ফোন নিয়ে আসছে, অথচ তারা ব্যক্তিগত ব্যবহার করছে না। ফোনগুলো বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। তারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজটি করছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ফোন আনার কৌশল হিসেবে আরো জানাা গেছে, সঙ্ঘবদ্ধ চক্র ১০-২০ জন ক্যারিয়ার ঠিক করে, যারা দেশের বাইরে যান। তাদের মাধ্যমে ফোনগুলো নিয়ে আসে। তাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অবৈধ ব্যবসায় করা। এ ক্ষেত্রে তারা ‘ব্যাগেজ রুল’ আইনের সুযোগটি নেয়। অন্য দিকে কাস্টমস ফাঁকি দিয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তার সহায়তায় বিপুল ফোন সেটও দেশে প্রবেশ করানোর অভিযোগ রয়েছে।

যদিও অবৈধভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানি বন্ধ করতে বিটিআরসি, জাতীয় রাজস্ব কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তবুও এ অবৈধপথে ফোন সেট আমদানি থামছে না।
সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বসুন্ধরা সিটি মার্কেট, ধানমন্ডির অরচার্ড ও গুলশানের মলিক্যাপিটা মার্কেটে বিটিআরসি, শুল্ক গোয়েন্দা ও ডিএমপি একসাথে অভিযান চালায়। এই অভিযানে চোরাইপথে আনা আইফোন টেনসহ অন্যান্য মূল্যবান ব্র্যান্ডের দুই শতাধিক মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। এসব ব্র্যান্ডের মধ্যে আইফোন, স্যামসাং গ্যালাক্সি এস-৮, নোকিয়া এক্স-৩, ব্ল্যাকবেরি ফোন সেট রয়েছে। এ সময় একটি ড্রোনও উদ্ধার করা হয়। এসব ফোন কোনো অনুমোদন ছাড়াই দেশের বাজারে ছাড়া হয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আইফোন টেনের এখনো আইএমইআই নম্বর বিটিআরসি দেয়নি। অথচ এসব লেটেস্ট মডেলের ফোন বাজারে দেদার বিক্রি করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত ব্যবহারের কথা বলে একটি চক্র শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব ফোন দেশে নিয়ে আসছে। এরপর সেগুলো বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে শুল্ক ফাঁকির পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে বলে দাবি করছে বিটিআরসি ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে বসুন্ধরা সিটিতে অভিযান পরিচালিত হয়। তিনি অভিযান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখানে দেখলাম, খুবই দামি ফোন আইফোন টেন, যা বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এই ফোন এখনো বিটিআরসি থেকে অনুমোদন পায়নি। এটা বিক্রি হওয়ার মানেই সরকারের রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে। এমনকি এটি নকলও হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হতে পারে। এই ফোনে নিরাপত্তার ঝুঁকিও থাকতে পারে।’
বসুন্ধরায় জব্দ করা সেটে সরকারের ৩০-৪০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে বলে জানান তিনি।
মোবাইল সেট আমদানিকারকদের সংগঠন মোবাইল সেট ইমপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া শাহেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ অনুযায়ী, বাংলাদেশে যেকোনো মোবাইল ফোন সেট বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করতে হলে বিটিআরসির অনুমোদন এবং সেগুলোর আইএমইআই নম্বর আগেই নিবন্ধিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সেই নীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধপথে মোবাইল সেট আমদানি অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে একদিকে যেমন সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে অন্য দিকে এসব সেটের কারণে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে।
মোবাইল সেটকে একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি এক সময় ফ্যাশন ছিল। এখন তা নিত্যপণ্য হয়ে উঠেছে। সেজন্য অবৈধ ও অনৈতিকভাবে সেট আমদানি বন্ধ করতে সেট আমদানির ওপর আরোপিত শুল্ক সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। একই সাথে নিয়মিত অভিযান জোরদার করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এ দিকে অবৈধ হ্যান্ডসেটের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে জাতীয় পর্যায়ে একটি ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) স্থাপনের কথা ভাবছে বিটিআরসি। সংস্থাটি জানিয়েছে, এটি স্থাপন করা হলে দেশে অবৈধভাবে হ্যান্ডসেট আমদানি বন্ধ করা যাবে। এতে চুরি হওয়া সেট আলাদাভাবে ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকবে, অপারেটরদের ইআইআরসমূহ ব্যবহার করে এক্সেস কন্ট্রোল ব্যবস্থার মাধ্যমে চুরি হওয়া মোবাইল সেটের পুনঃব্যবহার ঠেকানো যাবে। বৈধভাবে আমদানিকৃত হ্যান্ডসেটের এক বা একাধিক ইউনিক আইএমইআই নম্বর থাকবে। বৈধভাবে আমদানি হওয়া সেটগুলোই কেবল মোবাইল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হতে পারবে। এটি অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। জাতীয়ভাবে আইএমইআই ডাটাবেইজ সংরক্ষণের মাধ্যমে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি অনেকটাই হ্রাস পাবে। কোনো ধরনের অপরাধ কার্যক্রমে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর ও মোবাইল হ্যান্ডসেট শনাক্তকরণের মাধ্যমে অপরাধী চিহ্নিত করতে সহজ হবে এবং এর মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা হ্রাসসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আইএমইআই ক্লোনিং বন্ধ হবে। এ জন্য এনইআইআর স্থাপনের আগে সব মোবাইল ফোন অপারেটরদের নিজ নিজ নেটওয়ার্কে ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি (ইআইআর) স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া এনইআইআর কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য উন্মুক্ত নিলাম পদ্ধতি প্রয়োগেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, গ্রাহকের স্বার্থ বিবেচনা করেই আমরা ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি বাস্তবায়ন হলে অবৈধ পথে হ্যান্ডসেট আমদানি বন্ধ হবে। পাশাপাশি গ্রাহকেরাও প্রতারণার হাত থেকে বাঁচবে। এ ছাড়া ভুয়া আইএমইআই ব্যবহার করে যে অনৈতিক ও অবৈধ কার্যক্রম পরিচালিত হয় তা বন্ধ হবে এবং সেট হারিয়ে গেলে তা উদ্ধার করাও সম্ভব হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/270517