২২ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২১

আমার আব্বা আমার অনুপ্রেরণা

আলী আহমাদ মাবরুর

দেখতে দেখতে দুই বছর হয়ে গেল সেই ভয়াল রাতের। ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর দিবাগত রাতে আমার পিতা আলী আহসান মো: মুজাহিদ শাহাদাতের মর্যাদা নিয়ে দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে গেছেন। এ বছর আব্বাকে নিয়ে কিছু লেখার চিন্তা ছিল না। এক বছর আগে যখন আব্বাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলাম তখন এক বাস্তবতায় ছিলাম। এবার ভিন্ন এক বাস্তবতায়। এবারের লেখাটি হয়তো তাই অনেক বেশী পারসোনাল হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে আমি মানসিকভাবে খুব অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, কি করবো, কোথায় থাকবো, কোথায় যাবো- সব নিয়ে প্রচন্ড দোটানায়। এই সময়টাতে এসে আমি প্রচন্ডভাবে আমার আব্বাকে অনুভব করছি। ক’দিন আগে আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। তাকে এই বিষয়গুলো খোলামেলা শেয়ার করলাম। তিনি একটা পর্যায়ে বললেন, ‘তোমার এত কিছু ভাবার দরকার কি? নিজে যেটা করতে চাও সেটা কর। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নাও।’ আমি তাকে উত্তরে বললাম, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে কিভাবে নিতে হয় আমি তো তা শিখিনি। আমি ছিলাম আমার আব্বার খুব কাছের। তিনি তার জীবনের মুক্ত অবস্থায় শেষ যে ১০ বছর পার করেছেন, আমি সেখানে ছিলাম তার ছায়াসংগী। তার সকল কাজের অংশীদার। তার স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার। আব্বার শেষ ১৫-১৬ বছর আর আমার জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আমি আমার জীবনে কোনকিছু আব্বার অনুমতি ছাড়া করিনি। কাজ শুরু করার আগে তার সাথে কথা বলেছি, তিনি অনুমতি দিলেই করেছি, নতুবা নয়। আব্বা যা বলবেন এর বাইরে কিছু করিনি, সেটার প্রয়োজনও বোধ করিনি, আর তেমনটা শিখিওনি। আব্বা চলে যাওয়ার পর যখন আমি নিরেট বাস্তবতায় পড়ে গেলাম, তখন পৃথিবীটা বড্ড কঠিন হয়ে গেল আমার জন্য। কে দেবে আমাকে তার মতো করে পরামর্শ? আমার চারপাশে পরামর্শ দেয়ার লোকের অভাব নেই। কিন্তু যে যা বলে, সে আসলে তার দৃষ্টিভংগি থেকেই বলে।

আমার ভাল লাগা বা আমার চাওয়াকে বিবেচনা করে বলে না। আমি সেগুলো মেনে নিতে চাই, কিন্তু পরে মানসিক চাপে পড়ে যাই। সবমিলিয়ে খুব কষ্ট নিয়ে সময় কাটে। আব্বা থাকলে এমনটা হতো না, তিনি সবার আগে বুঝতে চাইতেন আমি কি চাই, কোন্্টা করতে আমার ভাল লাগে। তাই তাকে মিস করছি ভীষণভাবে। আমি জীবনে প্রথম সংকটে পড়ি আমার এসএসসি পরীক্ষার সময়। ভীষণ রকম অসুস্থ ছিলাম। পরীক্ষা দিতেও পারবো না- এমন একটা অবস্থা। আব্বা আমাকে বললেন, তুমি কি সাহস পাও পরীক্ষা দেয়ার? আমি বললাম পাই। আমার তখন লাংগসে পানি জমেছে অনেক পরিমাণে। প্রতিদিন ২০টার বেশী ট্যাবলেট খেয়ে পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম। দুটা পরীক্ষা দিয়ে একদিন বাসায় ফিরে বমি করলাম। অনেক কান্না করলাম। হাল ছেড়ে দিলাম। আব্বা সাহস দিলেন। বাকি পরীক্ষাগুলো দিলাম। আল্লাহর রহমতে স্টার মার্ক নিয়ে পাস করলাম। অনার্স পরীক্ষায় এসে আবার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ি। প্রত্যাশা অনুযায়ী রেজাল্ট হলো না। পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লাম। আব্বা দেখলাম একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন। বললেন, মাস্টার্স ভাল মতো দাও। আমি সাহস পেলাম। গোল্ড মেডেল নিয়ে মাস্টার্স পাস করলাম আল্লাহর রহমতে। এরকম জীবনের প্রতিটি বাঁকে আব্বা আমাকে আমার মত করে চলতে দিয়েছেন।

তিনি শুধু এটা নিশ্চিত করতেন যাতে আমি দ্বীনের পথে থেকেই আমার সীমিত যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারি। আমি আগাগোড়াই লেখালেখি করতাম। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় একদিন আব্বাকে বললাম, আমি চাকরি করতে চাই। তখন আমি মাস্টার্স পড়ছি। আব্বা মন্ত্রী হলেও আমার পকেট খালি। টাকা পয়সা লাগে, কিভাবে চলবো? আব্বা বললেন সংগ্রামে চাকরি কর। তোমার ইচ্ছাও পূরণ হবে, আমরাও কিছু সার্ভিস পাবো। সংগ্রামে বেতন পেতাম সাড়ে ৫ হাজার টাকা। এটা নিয়ে কোন আক্ষেপ ছিল না। আব্বা সেভাবে বড়ই করেননি আমাদের। আমি ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত ১০ হাজার টাকার নীচে বেতনের চাকরি করেছি নিরন্তরভাবে। আব্বার কাছে এগুলো বলে কোন লাভ হতো না। তার কাছে বেতন কোন বড় বিষয় নয়, সার্ভিসটাই বড়। সব বাবাই সন্তানের কাছে অতি প্রিয়। কিন্তু আমার বাবা শুধু আমার প্রিয় নয়, তিনি আমার প্রেরণার উৎস।

এর কারণ হলো আমার বাবার মধ্যে আমি এমন কিছু দেখেছি, যা সাধারণভাবে আমি অন্য কোন পিতার মধ্যে দেখিনি। উদাহরণ দিয়ে বলি। ২০১৩ সালে আমার চাকরি চলে যায়। দিগন্ত টেলিভিশনে আমি চাকরি করতাম। স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আব্বা জীবিত ছিলেন। এরমধ্যে অসংখ্যবার আমার সাথে তার দেখা হয়েছে। এটা নিয়ে কোনদিন তিনি কোন উদ্বেগ দেখাননি। কোনদিন বলেননি, এখানে যাও, ওখানে যাও। চাকরির চেষ্টা কর ইত্যাদি। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা দেখতেন। বলতেন, আন্দোলন কত বড় বিপদে আছে, তোমার চাকরি এখানে খুব বড় বিষয় নয়।

আল্লাহ রিজিকদাতা, তোমার সমস্যা হবে না ইনশা আল্লাহ। আল্লাহর রহমতে সমস্যা হয়ওনি। আজ প্রায় চার বছরের বেশী সময় ধরে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কোন চাকরি করি না, আল্লাহ খুব ভালভাবেই রেখেছেন আমাকে। আরেকটা বিষয়ও খুব ব্যতিক্রম ছিল আব্বার মধ্যে। অধিকাংশ বাবাই তার সন্তানদেরকে বিপদে বা ঝুঁকির মধ্যে রাখতে চান না। নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেন। এইক্ষেত্রে আব্বা একটু ভিন্ন চিন্তাধারা লালন করতেন। আমার মনে আছে, একবার সার্বিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা বেশ জটিল হয়ে গেল। আমি যেহেতু আব্বার মামলা মোকদ্দমার সাথে জড়িত ছিলাম, তাই আমাকে নিয়েও আমার শুভাকাংখিদের উদ্বেগটা বেশী ছিল। আমি একদিন আদালতে আব্বাকে বললাম, অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন, আমি যেন বাসায় না থাকি। আব্বা বললেন কেন থাকবে না, তুমি তো কোন অপরাধ করোনি। বিপদ যদি আসে তাহলে সেটাকে সাহসের সাথে ফেইস করাই তো মুমিনের কাজ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি আবার বললেন, দেখো সতর্ক থাকতে হবে। সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। নিজেকে সেভও রাখবা। কিন্তু সেটা কাজ করার জন্য। তোমাকে আমি সতর্ক থাকতে বললাম আর তুমি স্বাভাবিক কাজ থেকে সরে গিয়ে নিরাপদে থাকলা, কাজ করলা না, তাতে কি লাভ হবে? সুতরাং সতর্ক থাকতে হবে, আবার স্বাভাবিক কাজ যতো করতে হবে। আব্বার আরেকটি বিষয় ছিল অনুকরণীয়। জানি না এটা পারবো কিনা। তিনি অসম্ভব রকমের সরল ও সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। তার পোশাকে, তার খাদ্যাভাসে সেই সরলতার প্রতি”্ছবি ফুটে উঠতো।

২১ আগস্টের মামলায় কোর্টে লাঞ্চের সময় সব অভিযুক্তের পরিবার সপ্তাহে একদিন তার আপনজনকে খাওয়ানোর সুযোগ পেত। সবাই দেখতাম খাবার আনতো অভিজাত ধরনের, স্যান্ডউইচ, ফ্রাইড রাইস, বার্গার ইত্যাদি। আমি বাসা থেকে নিয়ে যেতাম, কচু শাক, কাচকি মাছ, ডাটা চচ্চরি, বা কালোজিরা ভর্তা ইত্যাদি। আব্বা যে শুধু রিচ ফুড পছন্দ করতেন না তাই নয়, তিনি রিচ কিছুই পছন্দ করতেন না। ‘ও কত বেতন পায়, ও খুব ভাল অবস্থায় আছে, কিংবা ও বাসায় এতটাকা দেয়’, এই সব কথা আমি জীবনে কখনো আব্বার কাছে শুনিনি। আমি সেভাবে বড় হইওনি। আর এখন চারপাশে যখন প্রতি মুহূর্তে বাড়ি, গাড়ি কিংবা বেতনের কড়কড়ে টাকার নোটের আলাপ শুনি, তখন নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। আব্বার প্রিয় উক্তি ছিলো তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ। কোর্টে, জেলখানায় যখনই কথা বলেছি, বার বার এটা বলতেন। কিছু হলেই বলতেন।

আমরা অনেকে মনে করতাম, এটা তার অভ্যাস, বলবেনই। কিন্তু তিনি এটা মানতেন। প্রতিটি মিনিটে মানতেন। চাকরিহীনতা, অসুস্থতা, অভাব, নিরাপত্তা যে কোন ইস্যুই আমাদের সামনে আসতো, তিনি ঘাবড়াতেন না। আব্বাকে কোন কিছু নিয়ে কখনো পেরেশান হতে দেখিনি। তিনি যেভাবে আল্লাহর উপর আস্থা রাখতেন আমি তার কোন নজীর এখন আমার আশেপাশে আর কারও মধ্যেই দেখি না। তাই তার অভাবটা খুব বোধ করি। গতকাল আমার আব্বার অত্যন্ত প্রিয় সহকর্মী ও দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আব্বাকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণ লিখেছেন। লেখাটা পড়ে আমি কেঁদেছি। একটা লাইন আমি পড়ে ধাক্কা খেয়েছি। আব্দুর রাজ্জাক চাচা লিখেছেন, ‘আলী আহসান মুজাহিদের অভাব বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনে কখন পূরণ হবে?’ জানি না কখন পূরণ হবে, দোয়া করি খুব দ্রুতই পূরণ হোক।

কিন্তু আমার পিতার অভাব তো কোনদিন আর পূরণ হবে না। আল্লাহর কাছে দোয়া, আমরা যেন সেই অভাবটা কখনো বোধ না করি। ব্যক্তিগতভাবে আমি সবসময়ই আব্বার কথা স্মরণ করি, আমার মাথায় অন্য কিছু সহজে আসে না। কাজ নিয়ে বসলেও, পড়তে বসলেও তার কথাই মনে পড়ে। কাজ ছেড়ে উঠে যাই। ফলে কাজটা আর আগায় না। আমি কিভাবে তাকে ভুলবো? আমার জীবনের এই পর্যন্ত যা স্মৃতি, যা অগ্রগতি, যেই অবস্থান, পুরোটা জুড়েই তো তিনিই। পরিশেষে বলতে চাই, আব্বা শেষ সাক্ষাতে আমাদেরকে যেই কথাগুলো বলে গেছেন সেগুলোই আমাদের বাকি জীবনের পাথেয়। আমরা যেন তার মত সাদাসিধে হতে পারি, বলিষ্ঠ হতে পারি, দেশ ও জাতিকে সার্ভিস দিতে পারি, আল্লাহর উপর সর্বাবস্থায় তাওয়াক্কুল করতে পারি। আমিন।

http://www.dailysangram.com/post/308548