২১ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:২২

বড় ঋণের টাকা আদায়ে ধীরগতি ৩০ ব্যাংকের ১৪টিতে অর্থসংকট

শাহেদ মতিউর রহমান : গ্রাহকদেরকে দেয়া বড় অংকের ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব ঋণের অর্থ ফেরত আসলেও তা আসছে খুবই ধীরগতিতে। ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণায় ব্যাংকগুলো বড় অংকের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক অবস্থানের কথা বলা হলেও শেষ অবধি সেই আশংকাই সত্যি হলো। ব্যাংকগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ১৪ ব্যাংকের এই আর্থিক সংকটের চিত্রই স্পষ্ট হয়েছে।

সূত্র বলছে, ব্যাংকের আর্থিক সংকটের জন্য গ্রাহক পর্যায়েও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একদিকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যেমন রাজনৈতিক চাপ থাকে তেমনি আদায়ের ক্ষেত্রে থাকে নানা প্রতিবন্ধকতা। ফলে উভয় সংকটে রয়েছে এই ব্যাংকগুলো। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ শতাংশই দেয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণধারী গ্রাহককে। কিন্তু সময়মতো টাকা ফেরত না আসায় এসব ঋণ এবং আর্থিক সংকট নিয়েও এখন দুশ্চিন্তায় ব্যাংকগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ১৪টির নগদ অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- ব্যাংক এশিয়া, যমুনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেই তাদের এই আর্থিক সংকটের চিত্র পাওয়া গেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাস শেষে এ ১৪ ব্যাংকের পরিচালন নগদ প্রবাহ বা অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ার অর্থ ওই প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থের সংকট সৃষ্টি হওয়া। ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিতরণ করা ঋণ প্রত্যাশা অনুযায়ী আদায় না হওয়া পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ার একটি অন্যতম কারণ হতে পারে ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে তা কোয়ালিটি সম্পন্ন নয়। ফলে আশানুরূপভাবে ঋণ আদায় হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ হলো কিছু না কিছু সমস্য সৃষ্টি হচ্ছেই। এ সমস্যা যদি দ্রুত সমাধান করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এতে ব্যাংকের মুনাফায় ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। আবার মুনাফার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যাংক আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করতে পারে। এতে সংকট আরও বাড়বে।
বিআইবিএম এর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ শতাংশই দেয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণধারী গ্রাহককে। কিন্তু সময়মতো টাকা ফেরত না আসায় বড় এসব ঋণ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় ব্যাংকগুলো। বড় গ্রাহকদের নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুশ্চিন্তার কথা স্বীকার করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরাও।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা বলছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহক নয়, বড় গ্রাহকদের কাছেই যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের বড় অংশ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, বড় ঋণ যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তা আর ফেরত আসছে না। ফলে এসব ঋণ আদায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর দুশ্চিন্তাও বাড়ছে।

বিআইবিএমের ‘ক্রেডিট অপারেশনস অব ব্যাংকস-২০১৬’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ করেছেন, এমন গ্রাহকের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মাত্র ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন, এমন গ্রাহকদের কাছে ১৭ শতাংশ এবং ১ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন, এমন গ্রাহকদের কাছে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। অথচ ব্যাংকগুলোর ৪৭ দশমিক ৯২ শতাংশ ঋণ রয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকদের কাছে। যদিও ২০১৫ সাল শেষে এ শ্রেণীর গ্রাহকদের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ ছিল ৪৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

সূত্রমতে, জুন মাস পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক ছিল। শেষ তিন মাসের ব্যবসায় নতুন করে ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মকের তালিকায় নাম লিখিয়েছে এক্সিম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের নগদ অর্থ সংকটের পাশাপাশি সম্পদমূল্যও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদমূল্য ঋণাত্মক আছে ১৫ টাকা ৫৪ পয়সা।
এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে আগের বছরের তুলনায় চারটি ব্যাংকের সম্পদমূল্য কমে গছে। সম্পদমূল্য কমে যাওয়া ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে- সাউথইস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং পূবালী ব্যাংক।
এর মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই নগদ অর্থ সংকটেও রয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক পাঁচ টাকা ৬৬ পয়সা। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ার প্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ ছিল ঋণাত্মক পাঁচ টাকা। অবশ্য আগের বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ক্যাশ ফ্লো ধনাত্মক ছিল।
ব্যাংক পরিচালনা কাজের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়লে প্রতিষ্ঠানটিতে নগদ অর্থের সংকট তৈরি হয়। এতে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে অর্থের প্রয়োজন হলে তা যোগানে সমস্যার সৃষ্টি হয়। শেয়ারহোল্ডারের জন্য নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তারা বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিচালন নগদ প্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিকেটর (সূচক)। তবে একটি প্রান্তিকের (তিন মাসে এক প্রান্তিক) আর্থিক অবস্থা দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। বিভিন্ন কারণে হঠাৎ যে কোনো প্রান্তিকে আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক থাকলে বুঝতে হবে ওই প্রতিষ্ঠান সংকটের মধ্যে রয়েছে। আর যে প্রতিষ্ঠানের নগদ প্রবাহ ঋণাত্মকের পরিমাণ যত বেশি হবে ওই প্রতিষ্ঠানের সংকটের মাত্রা তত বেশি হবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/308494