২১ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:২১

এ যেন মানবতার এক অনন্য নজির

সুশাসন

ইকতেদার আহমেদ

বাংলাদেশকে বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দাবি করা হলেও এখনো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে দেশটির উত্তরণ ঘটেনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১১ অনুযায়ী, চরম দারিদ্র্যসীমা ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত লোকের সংখ্যা যথাক্রমে শতকরা ২৫ ও ৪০ ভাগ। দারিদ্র্যসীমার এ হারকে ২০২১ সালের মধ্যে শতকরা ১৫ ভাগের নিচে নামিয়ে আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যটি অর্জিত হলে দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান উপমহাদেশের প্রভাবশালী দু’টি রাষ্ট্্র ভারত ও পাকিস্তানের অগ্রে হবে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। প্রতি বছর যে হারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে সম্পদ ও চাকরির সুযোগ বাড়ছে না। জনসংখ্যাকে সীমিতপর্যায়ে রাখা বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে জনসংখ্যা বেড়ে চলা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবেÑ বিশেষজ্ঞরা এমনই অভিমত ব্যক্ত করেন।
বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী। প্রতি বছর বাংলাদেশের কোনো-না-কোনো অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়ে ফসলহানির ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয়-পরবর্তী প্রায় ৪৬ বছরের মধ্যে দেশটিকে ১৯৭৪, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে তিনটি বড় ধরনের বন্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ তিনটি বন্যায় দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বছর এ দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় দেশটির ওপর আঘাত হানে। এ ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মানুষ, গবাদিপশু ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং ২০০৭ সালে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে জানমাল ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। উপরোল্লিখিত প্রতিটি দুর্যোগের সময় দেখা গেছে, এ দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাদের সাধ্য অনুযায়ী বিপন্ন মানবতার সেবায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে দুর্ভোগ লাঘবে সহায়তা করেছেন। ১৯৮৮ ও ’৯৮-এর বন্যায় যখন দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের বাড়িঘর পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল তখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বন্যাকবলিত মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেয়ার জন্য রুটি বানিয়ে বিভিন্ন ধরনের জলযানে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিয়েছেন। এমনকি বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক যারা নিজেরাই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জড়িত, এসব দুর্যোগে এরাও নিজেদের সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী একযোগে বিপন্ন ও দুর্গতদের চাহিদানুযায়ী খাদ্য ও দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রণকৌশল ছিল গেরিলা যুদ্ধ। এসব গেরিলা যোদ্ধার গ্রামাঞ্চলের মানুষ নিজেদের জীবন ও সম্পদ তুচ্ছ করে আশ্রয়, খাদ্য ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল। এ সহায়তার কারণে গেরিলাদের চোরাগোপ্তা হামলা-পরবর্তী দখলদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহায়ক দোসরেরা আশ্রয়দাতা পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যকে হত্যা করাসহ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এর পরও এ দেশের মানুষ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চরম আত্মত্যাগের মানসে সহায়তা দিতে কখনো দ্বিধান্বিত হননি।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ দেশটির স্বাধীনতা লাভের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। আরাকানে বসবাসরত মুসলমান রোহিঙ্গা নামে অভিহিত। এরা সেখানে বংশপরম্পরায় হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতো তারা জন্মগতভাবে বার্মার নাগরিক। বার্মার স্বাধীনতা-পরবর্তী সেখানকার প্রথম ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপ্রধান যথাক্রমে অং সান ও উনু দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতো রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক বিবেচনায় সব ধরনের অধিকার ভোগ করার সুযোগ দেয়। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় সামরিক শাসক নে উইন ক্ষমতাসীন হলে। তিনি অভিনব নাগরিকত্ব আইন দিয়ে ১৮২৩ সালের আগে থেকে যারা বংশপরম্পরায় বার্মার নাগরিক, শুধু তাদেরই নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রোহিঙ্গাদের এক বড় অংশকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি জ্ঞাপনে অনীহা ব্যক্ত করেন। নে উইনের এ ঘোষণার পর ১৯৬২ সালে রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে শরণার্থী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসা শুরু হয়, যা বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয়ের পর ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ব্যাপকতা লাভ করে। ১৯৭৯ সালে সম্পাদিত একটি চুক্তির অধীন স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর আরাকানে প্রত্যাবর্তন ঘটলেও আগত শরণার্থীর ব্যাপক অংশ এখনো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে অবস্থান করছে। ১৯৬২ সাল থেকে ২০১৬ অবধি যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধ্য হয়েছে, সে তুলনায় ২০১৭ সালে অর্থাৎ বর্তমান বছরে আগত শরণার্থীর সংখ্যা তার চেয়ে অধিক। বর্তমানে এখনো প্রতিদিন অসহায় ও বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ ঘটছে।

মিয়ানমারের সেনা শাসকেরা ২৫ আগস্ট ২০১৭ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামের একটি সশস্ত্র সংগঠন তাদের সেনা ও পুলিশ চৌকির ওপর হামলা চালিয়ে হত্যার ঘটনা সংঘটিত করে এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চরম অত্যাচার ও নিষ্পেষণ চালিয়ে তাদের নির্বিঘেœ হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালালে এরা নিরুপায় হয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ অভিমুখে পাড়ি জমায়। এ দেশে পালিয়ে আসাদের বিবরণ থেকে জানা যায়, আরাকানে আরসা নামের কোনো সশস্ত্র সংগঠনের কার্যকলাপ নেই। মিয়ানমার সরকারের আরসা কর্তৃক হামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের দমনে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দেয়া হলে মিয়ানমার সরকার তাতে সম্মত হয়নি। বাংলাদেশের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় বিশ্বাস করার মতো কারণের উদ্ভব হয়েছে যে, আরসা কর্তৃক পুলিশ ও সেনা চৌকিতে আক্রমণের ঘটনা আরাকান থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়নের অজুহাতে সে দেশের সেনা শাসকদের সৃষ্ট কল্পকাহিনী।
এর আগে ২০১৬ সালে বর্তমানের মতো অনুরূপ অত্যাচার ও নিষ্পেষণের কারণে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশে উদ্যত হলে আমাদের সীমান্তরক্ষীদের বাধার মুখে তাদের প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সে সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশকালীন নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার কারণে যাত্রাপথে মৃত্যু ঘটে। বর্তমান বছরেও ২৫ আগস্ট-পরবর্তী রোহিঙ্গাদের আগমনের ঢল নামলে প্রথম দিকে তারা এ দেশের সীমান্তরক্ষীর বাধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু পরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা তুলে নেয়া হয়।

বর্তমান বছরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের আগে থেকে এ দেশে অবস্থানগত রোহিঙ্গার সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার মধ্যে শুধু ২৫ হাজার নিবন্ধিত, যারা জাতিসঙ্ঘ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাধীনে দু’টি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনিবন্ধিত অপর বড় অংশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে বসবাসরত সাধারণ জনমানুষের সহায়তায় আশ্রয় ও খাদ্যের সংস্থান ঘটছে।
বাংলাদেশের সব অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী আবেগপ্রবণ, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন এবং অপরের দুঃখ-বেদনায় সহানুভূতিশীল। এবার যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিজেদের মাতৃভূমি ও ঘরবাড়ির মায়া ছেড়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে সামান্য অর্থসম্পদ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এ দেশের সাধারণ মানুষ তাদের দুঃখ-বেদনায় মর্মাহত ও ব্যথিত। অকস্মাৎ এ বিপুলসংখ্যক প্রবেশকারীর আশ্রয় ও খাদ্যের জোগান দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় এ দেশের সাধারণ মানুষের সহায়তায় গঠিত এক হাজারের ঊর্ধ্বে ত্রাণদল নিজেদের উদ্যোগে খাদ্য, বস্ত্র, অর্থের ব্যবস্থা করে তাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে এগিয়ে এসেছেন। সাধারণ মানুষের গঠিত এসব ত্রাণদলের সাহায্য ও সহযোগিতার কারণে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রোহিঙ্গারা রক্ষা পেয়েছে।
সরকার ও বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র বিশেষত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে সাহায্য ও ত্রাণ আসা অব্যাহত থাকলেও সমন্বয়ের মাধ্যমে এর সঠিক ব্যবহার ও বণ্টন সময়সাপেক্ষ বিধায় জনমানুষের সহায়তায় দেয় ত্রাণ দিয়েই সাময়িক তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইসহ দৈনন্দিন আহারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এ বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন পর্যায়ে বন্যার কবলে পড়েছে। বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও অধিক। এদের খাদ্যসহায়তা ও পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসেছে এবং এ কার্যক্রমটি এখনো অব্যাহত। নিজ দেশের মানুষ যখন বিপদের মুখোমুখি, তখন এ দেশের মানুষ যেমন মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, অনুরূপ বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের প্রতিও সাহায্যের হাত বাড়াতে কোনো দ্বিধায় পড়েনি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় সামগ্রিকভাবে এ দেশের মানুষ যেভাবে নিজ দেশের মানুষসহ পার্শ্ববর্তী দেশের মানুষের ব্যথায় মর্মাহত ও ব্যথিত, এমন নজির পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ জাতিগত বিভেদ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বারবার বিপদগ্রস্ত ও বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রতিটি পরীক্ষায়ই তারা অতীতে যেমন সফলতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছে, এবারো যে ব্যর্থ হবে না তা ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ বলে দেয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান,
রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/270134