২০ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:২৮

দুর্বল বেতন কাঠামোর কারণেই কর ফাঁকির সুযোগ পাচ্ছেন বিদেশীরা

এইচ এম আকতার: কর ফাঁকি দেয়া এখন বিদেশীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এজন্য বেতন কাঠামোকে দায়ী করলেন সংশ্লিষ্টরা। দুর্বল বেতন কাঠামোর কারণেই কর ফাঁকির সুযোগ পাচ্ছেন বিদেশীরা। কর ফাঁকিরোধে দেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের বেতন কাঠামোতে পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(বিডা)। রাজস্ব খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যথাযথ বেতন কাঠামোর অভাবেই বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন বিদেশীরা। এমনকি মুদ্রা পাচারও হচ্ছে।
বেসরকারি খাতের ব্যাপক প্রসারের ফলে বাংলাদেশে কাজের সুযোগ পাচ্ছে বিদেশী কর্মীরা। ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানাসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রচুর বিদেশী কাজ করছে। এরা সংখ্যায় কত-তার প্রকৃত হিসাব না থাকলেও ১২ লাখের কম নয়।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হিসাবে, বর্তমানে তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছে ৩ হাজার ৭২৭ জন বিদেশী। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৪০ জন। আর এনজিও ব্যুরো ও বেপজা যোগ করলে তা সাড়ে ১৬ হাজারের বেশি নয়। এদের মধ্যে আয়কর দিচ্ছেন ১১ হাজার বিদেশী।
তবে, যেসব বিদেশী আয়কর দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই তথ্য গোপন করছেন। এর অন্যতম কারণ বিদ্যমান ন্যূনতম বেতন কাঠামো। সার্কভুক্ত, চীন, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ নূন্যতম বেতন ধরা হয়েছে সাড়ে ৬৫০ মার্কিন ডলার থেকে ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের ক্ষেত্রে যা যথাক্রমে ৮৫০ মার্কিন ডলার থেকে দেড় হাজার মার্কিন ডলার। আর উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার মার্কিন ডলার নূন্যতম বেতন গ্রহণযোগ্য।

শিগগিরই বিদেশী শ্রমিকদের নূন্যতম বেতন কাঠামো পরিবর্তন আনার বিষয়ে সরকার গঠিত কমিটি আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানায় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিডা। বিদেশী কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কেউ মানছে না নীতিমালা। নিজেদের ইচ্ছামত বেতন নির্ধারন করে তাদের নিয়োগ দেখানো হচ্ছে। আর এ কারনেই তাদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, বিদেশী কর্মীদের কর ফাঁকি ঠেকাতে দেশি-বিদেশী করপোরেট প্রতিষ্ঠানে অভিযান শুরু করেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এ কাজে সহায়তা করবে না, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি আছে সংস্থাটির।
জানা গেছে, বৈধ-অবৈধ যে ১২ লাখ বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে বসবাস করছে তাদের অধিকাংশের বেতনই দেড় লাখ টাকার উপরে। অনেকের বেতন ৫ লাখেও উপরে। এসব বিদেশী নাগরিকের সবাই দক্ষ শ্রমিক। যাদের বেতন মাসিক ২৫ হাজার টাকা তারাই আয় কর দেয়ার কথা। এ হিসেবে ১২ লাখ বিদেশী নাগরিকই আয় কর দেয়ার কথা। হিসেবে মতে ১২ লাখ বিদেশী নাগরিকের কর আসার কথা কয়েক’শ কোটি টাকা। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১৬ হাজার নাগরিক আয় কর দাখিল করে থাকে। তাহলে বাকিরা কেন আয় কর দেন না। এজন্য সংশ্লিষ্টরা এনবিআরকে দায়ী করেছেন।

এনবিআর সারা দেশে চিরুনি অভিযান চালালেও এসব বিদেশী নাগরিকদের খুঁজে পাচ্ছে না তারা। লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলেও এনবিআরের জালে আটক হচ্ছে না তারা। এতে করে সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। এদেরকে জাতীয় ডাটাবেজের এবং নতুন বেতন কাঠামোর আওতায় আনা গেলেই আয় কর বাড়বে কয়েকশ’ গুণ। অন্যদিকে অপরাধপ্রবণতাও কমতো। কিন্তু এনবিআরের উদাসিনতার কারণেই ডাটাবেজ এবং নতুন বেতন কাঠামোর আওতায় আসছেনা বৈধ-অবৈধ এসব বিদেশী নাগরিক। ফলে কোন প্রতিকূলতা ছাড়াই কর ফাঁকি দিচ্ছেন এসব বিদেশী নাগরিকরা। অথচ আমাদের প্রবাসীু নাগরিকরা কোন দেশেই কর ফাঁকি দিতে পারছে না। তাহলে আমরা কেন বিদেশী নাগরিকদের কর ফাকিরোধ করতে পারবো না।
যদিও বাংলাদেশে ঠিক কত বিদেশী নাগরিক কাজ করেন তার প্রকৃত সংখ্যা নেই কারো কাছে। বিনিয়োগ বোর্ড, বেপজা ও এনজিও ব্যুরো এ তিন প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, বৈধভাবে বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিক কাজ করছেন মাত্র সাড়ে ১৬ হাজার। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে অবস্থানরত বিদেশীর সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। যারা প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলারের সম পরিমাণ অর্থ আয় করে নিয়ে যান বাংলাদেশ থেকে। সবশেষ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ হাজার বিদেশী কর্মীর তথ্য আছে এনিবআরের কাছে। যার মধ্যে আয়কর বিবরণী পাওয়া গেছে ১০ হাজার কর্মীর।

এনবিআরের সদস্য(কর প্রশাসন)আব্দুর রাজ্জাক বলেন,যাদের টিন নম্বর রয়েছে তাদের অবশ্যই কর দিতে হবে। তা না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। নতুন বিদেশীদের করের আওতায আনতে আমাদের কর কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
তিনি আরও বলেন,আগে আমাদের বেতন কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। তার পরেই এসব বৈধ-অবৈধ নাগরিকদের করের আওতায় আনা যাবে। তিনি জানান,বর্তমানে যে বেতন কাঠামো রয়েছে তাতে অনেকেই করের আওতা বাহিভ’ত রয়ে গেছে। এজন্য বিডা কাজ করছে।

এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন,করযোগ্য হলে অবশ্যই কর দিতে হবে। এটি সারা বিশ্বে একই আইন চালু রয়েছে। কিন্তু কর আদায়ে যাতে কোন ধরনের হয়রানির শিকার না হন সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যদি তারা হয়রানির শিকার হন তাহলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এনবিআরের এমন উদ্যোগ নিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলছেন, অভিযান বা পরিদর্শন সঠিকভাবে হলে আপত্তি নেই। তবে কোনরকম হয়রানি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আয়কর আইন অনুযায়ী, বিদেশী কর্মীরা তিন মাস অবস্থান করলেই তার আয় -ব্যয়ের নথি চালু করতে হয়। তার ব্যত্যয় হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছে কর বিভাগ।

জানা গেছে শুধুমাত্র সার্কভুক্ত ৬ দেশের প্রায় সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকছে। ওইসব দেশের বৈধভাবে নাগরিক থাকছেন ২ লাখ ১৫ হাজার ৩শ ৬৬ জন। আর সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ওই ৬ দেশের নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ২৪।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নাগরিক হচ্ছে ভারতের এবং কম হচ্ছে মালদ্বীপের। ভারতের পর পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা ও ভুট্টান। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, অবৈধ এসব বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে অনেকেরই বর্তমানে ওয়ার্ক পারমিট নেই এবং ভিসার মেয়াদও শেষ। এরপরও তারা বিভিন্ন ব্যবসা ও চাকরি করছে। অনেকেই বাংলাদেশী জাল পাসপোর্ট এবং জাল ন্যাশনাল আইডি কার্ডও ব্যবহার করছে। কেউ কেউ বাংলাদেশের ভোটারও হয়েছে। এসব বিদেশী নাগরিকের সিংহভাগই ঢাকায় বসবাস করেন। এদেশের শ্রমবাজারের একটি অংশ দখল করে আছে। তারা বিভিন্নভাবে আয় করে উপার্জিত টাকার সিংহভাগই নিজ নিজ দেশে পাঠাচ্ছেন। ফলে একদিকে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং অন্যদিকে আর্থিকভাবে বাংলাদেশ সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাবে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকদের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এরমধ্যে বৈধ ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭ এবং অবৈধ প্রায় ১০ লাখেরও বেশি। পাকিস্তানের নাগরিক ৫৪ হাজার ৩শ ৭, বৈধ ২৪ হাজার ৩শ ৭ এবং অবৈধ প্রায় ৩০ হাজার। নেপালের নাগরিক ২৭ হাজার ৬, বৈধ ১২হাজার ২শ ৪০ এবং অবৈধ প্রায় ১৫ হাজার। শ্রীলংকার ৮ হাজার ৫শ ২৩, বৈধ ৫ হাজার ২৩ এবং প্রায় অবৈধ ১০ হাজার। ভুট্টানের ২০ হাজার ৫৬, বৈধ ১৬ হাজার ৭ এবং প্রায় অবৈধ ৪ হাজার এবং মালদ্বীপের ১৭ হাজার ৩২, বৈধ ৮ হাজার ৩২, বাকী প্রায় ৯ হাজার অবৈধ।

জানা গেছে, সরকার দেশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রাজস্ব আহরনের ক্ষেত্রে যতটা তৎপর বিদেশীদের কাছ থেকে কর আদায়ে ততটাই নীরব। কি কারনে এই নিরবতা পালন করছে তা বুঝা খুবই কঠিন। তাদের ডাটাবেজে আনতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ কারনে একদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার পরেও ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
সূত্র জানায় বর্তমানে বাংলাদেশে অফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের অবৈধ নাগরিক বসবাস করে থাকেন। নানা অপরাধ কর্ম কান্ডের সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। তানজানিয়া,নাইজেরিয়া,উগান্ডাসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক অবৈধভাবে বসবাস করছে। তারা আসলে এ দেশে কি কাজ করেন। কোথায় থাকেন তা কেই জানেনা। এ নিয়ে সরকারের কোন উদ্যোগও দেখা যাচেছ না।
দেশের গার্মেন্ট কোম্পানিগুলোতে কাজ করছেন কয়েক হাজার বিদেশী নাগরিক। গার্মেন্টস খাতে ১ থেকে দেড় লাখ বিদেশী কর্মরত আছেন। এই খাতে বিদেশীরা মোট কত টাকা উপার্জন করছে এর কোনো হিসাবই নেই। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কাজের অনুমতিপ্রাপ্ত মাত্র কয়েকশ ব্যক্তি রয়েছেন গার্মেন্ট শিল্পগুলোতে। এসব বিদেশী একবার বাংলাদেশে এসে যেন সোনার খনি পেয়ে আর ফিরে যান না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এনজিওবিষয়ক ব্যুরো থেকে অনুমতি নিয়ে এ দেশে কাজ করছেন মাত্র ৫০০ জনের মতো। কিন্তু বাস্তবে আছে প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি।
বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতি নিয়ে এদেশে কাজ করার কথা থাকলেও কত বিদেশী নাগরিক এদেমে কাজ করছে তার কোন সঠিক তথ্য নেই তাদের কাছে। একইভাবে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও জানেনা কত বিদেশী শ্রমিক কাজ করছে। তাহলে কিভাবে করের আওতায় আসবে এসব বৈধ-অবৈধ নাগরিক।

http://www.dailysangram.com/post/308331