সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে আগুন দেয়ার পর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উল্লাস (ফাইল ফটো)
১৯ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১১:১৯

সেই মিঠু-পঙ্কজসহ ২৯ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজ ছাত্রাবাস শিবির হঠানোর নামে আগুন দিয়ে ভষ্মিভূত করে দেয় সিলেটের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা দেবাংশু দাস মিঠু ও পঙ্কজ পুরকায়স্থ ও তার ক্যাডার বাহিনী। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্রাবাস শুধু পুড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি তারা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সামনে উল্লাস করেছে শিবির হঠিয়েছি বলে। হ্যাঁ এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল সিলেটের ছাত্রলীগের চিহ্নিত ক্যাডার বাহিনী ২০১২ সালে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়ে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সিলেটের একটি আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করায় নগরীর শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী ও এমসি কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ আনন্দ পরিলক্ষিত হচ্ছে। গতকাল শনিবার ছুটির দিনে নগরীর বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। লোকজনকে বলতে শোনা যাচ্ছে, সিলেট নগরীর টিলাগড় মার্ডার পয়েন্ট নামে খ্যাত টিলাগড়ের চিহ্নিত পঙ্কজ ও মিঠুর অনুসারীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা তো জারি হয়েছে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার সাথে ২৯ জন সংশ্লিষ্ট বলে প্রমাণ পেয়েছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের জের ধরেই এই নাশকতা চালানো হয়েছে বলেও তদন্তে জানা গেছে।

সিলেট চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে গত ১৫ নবেম্বর বুধবার প্রতিবেদন দাখিল করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
গত বৃহস্পতিবার সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিজ্ঞ বিচারক উম্মে সরাবন তহুরা ২৯ জন আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ২৯ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। পরোয়ানাগুলো সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
তদন্তে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের অগ্নিকা-ে যে ২৯ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তারা হলেন- সিলেট সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠু, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক (বরখাস্ত) সভাপতি পংকজ পুরকায়স্থ, আবু সরকার (বহিরাগত, শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি), জাহাঙ্গীর আলম (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), মৃদুল কান্তি সরকার, কামরুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে আইনজীবী ও বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউপি চেয়ারম্যান), বাবলা, মো. আতিকুর রহমান, লায়েক আহম্মেদ, সিদ্দিক আহম্মেদ ইউসুফ, জহিরুল ইসলাম, আক্তারুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, আসাদুজ্জামান শাহিন, মোহাম্মদ বিন মামুন বুলবুল, আউলাদ, আছরাফ আহমেদ শিপন, নজরুল ইসলাম, অলিউল্লাহ ওরফে ওলিউর রহমান, খুরশেদ আলম, বাছিদ ওরফে আবদুল বাছিদ, আবদুস সালাম, ইমতিয়াজ রফিক চৌধুরী, আবদুল্লাহ ফারুক, কয়েছ ওরফে কয়েছুজ্জামান তালুকদার, আবু রেহান, রুবেল ও জ্যোতির্ময় দাস সৌরভ।

তদন্তের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ‘ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় মামলার বাদীসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি ফের গ্রহণ করা হয়। ফলে সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র, জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিকা-ের ঘটনা ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের কারণেই সংঘটিত হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিলেট পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এরপর সিআইডি ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর আদালতে প্রথমবার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।
এরপর আবার তদন্ত করে সিআইডি ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট ফের আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনও আদালত গ্রহণ না করে পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের মাধ্যমে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দুই বার ও বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তে অপরাধী শনাক্ত না হওয়ায় আলোচিত এ মামলার ভবিষৎ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।
সর্বশেষ এ মামলার জট খুলতে গত ৩১ মে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে সারাবন তহুরা।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৮ জুলাই এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রশিবিরের মেধার যোগ্যতায় অবস্থানকারী নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য ছাত্রলীগ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করে ৪২টি কক্ষ পুড়িয়ে দেয়। একদিন পরই সিলেটের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অগ্নিসংযোগকারী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের গ্রেফতারের কঠোর নির্দেশ দেন। শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁর প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়ে যেতে দেখে চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর চোখের পানিকে নিয়েও উপহাস করেছে তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন। তাঁর নির্দেশকে উপেক্ষা করে পুলিশ গ্রেফতার করেনি ছাত্রলীগের সেই চিহ্নিত অগ্নিসংযোগকারী ক্যাডার বাহিনীকে। নগরবাসীর প্রশ্ন এখন কি এসএমপির শাহপরাণ থানা পুলিশ মিঠু পঙ্কজসহ ২৯ জন ছাত্রলীগের নেতাকে গ্রেফতার করবে? তৎকালীন এমসি কলেজ হোস্টেল সুপার বশির আহমদ বাদী হয়ে যে মামলা করেছিলেন সেই মামলার ২৯ জন আসামীকে কবে শাহপরাণ থানা পুলিশ হাতকড়া পড়াবে সেই অপেক্ষায় সিলেটের এমসি কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

http://www.dailysangram.com/post/308206