১৯ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:৫৬

ক্যাডার-নন ক্যাডারে পদমর্যাদার দ্বন্দ্ব

সব প্রক্রিয়া শেষ। তারপর আট মাস পেরিয়েছে, তবুও জারি করা যাচ্ছে না ২৮৩টি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করার গেজেট। শিক্ষকদের পদমর্যাদার বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়ায় আটকে গেছে এগুলোর জাতীয়করণ। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে চলতি মাসের শুরুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তের জন্য বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গোচরে এনেছে।

জাতীয়করণে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া সরকারি কলেজে কর্মরত ক্যাডার শিক্ষকরা চাইছেন, নতুন জাতীয়করণ হতে যাওয়া বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের 'নন-ক্যাডার' কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক। অন্যদিকে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা চাইছেন, আগে যেভাবে জাতীয়করণ করা হলে বেসরকারি শিক্ষকদের শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ করে ক্যাডার কর্মকর্তা করা হয়েছে, তাদেরও সেভাবে পদমর্যাদা দেওয়া হোক।

এ প্রসঙ্গে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী সমকালকে জানান, তারা জাতীয়করণের বিপক্ষে নন।

কিন্তু এসব কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্তি তারা মানবেন না। তাদের 'নন-ক্যাডার' করতে হবে। এ দাবিতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি 'নো বিসিএস, নো ক্যাডার' আন্দোলনে নেমেছে। সংগঠনটি ১৭ নভেম্বর নায়েমে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এর আগে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং শিক্ষা ভবন ঘেরাও করা হয়েছে।

আগামী ২৪ নভেম্বর তারা সারাদেশ থেকে এসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একত্রিত হয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

অন্যদিকে, জাতীয়করণ হতে যাওয়া কলেজ শিক্ষকরাও আন্দোলনে নেমেছেন। তারাও সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করে চলেছেন। তাদের দাবি- জাতীয়করণ হওয়া কলেজের সব শিক্ষককে শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা, কলেজ জাতীয়করণের প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকে চাকরি নিয়মিতকরণ, চাকরিতে যোগ দেওয়ার দিন থেকে অভিজ্ঞতা গণনা করে চাকরিকাল নির্ধারণ ও ২০০০ সালে করা আত্তীকরণ বিধিমালা অধিকতর সংশোধন করে শিক্ষকবান্ধব করা।

দেশের ৩১৩টি সরকারি কলেজে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ১৪ হাজার। তাদের ৮০ ভাগই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সরাসরি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া। এই ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তীব্র মতদ্বৈধতা দেখা দিয়েছে জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত ২৮৩টি কলেজের প্রায় আট হাজার শিক্ষকের। দুই পক্ষের প্রায় ২২ হাজার শিক্ষক এ ইস্যুতে গত আট মাস ধরে পাল্টাপাল্টি আন্দোলন করে আসছেন। স্পর্শকাতর ইস্যু হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও ভুগছে সিদ্ধান্তহীনতায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের পদমর্যাদা নির্ধারণের জন্য অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) ড. অরুণা বিশ্বাসকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটি তিনটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে। প্রথম প্রস্তাবটি হলো, প্রচলিত নিয়মে জাতীয়করণ হওয়া কলেজ শিক্ষকরা যেভাবে আত্তীকৃত (সরকারি) হয়ে ক্যাডারভুক্ত হয়ে আসছেন, বিষয়টি সেভাবেই রাখা; দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো, জাতীয়করণ হতে যাওয়া কলেজ শিক্ষকদের নন-ক্যাডার হিসেবে নিজ নিজ কলেজে রেখেই বদলি ও পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখা; তৃতীয় বিকল্প হলো, প্রচলিত নিয়ম ঠিক রেখে পদোন্নতিসহ চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে চাকরির সময়কাল সংশোধন করা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, তিনটি প্রস্তাবের মধ্য থেকে দুটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে কোন দুটি তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সমকালকে বলেন, জাতীয়করণের কাজ শেষ পর্যায়ে। দ্রুতই এটি সম্পন্ন করা যাবে।

দেশের যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ নেই, সেগুলোতে একটি করে কলেজ জাতীয়করণ করছে সরকার। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে মোট ২৮৫টি কলেজ জাতীয়করণের জন্য ঠিক করা হয়। তবে দুটি উপজেলায় একাধিক সরকারি কলেজ হয়ে যাওয়ায় সেই দুটি স্থগিত করা হয়েছে। ২৮৩টি কলেজ জাতীয়করণের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। জাতীয়করণের অংশ হিসেবে ওই সব কলেজের সব সম্পত্তি ইতিমধ্যে সরকারের নামে দান (ডিড অব গিফট) করা হয়েছে। এখন শুধু এ সংক্রান্ত গেজেট জারি বাকি।

নিয়মানুযায়ী জাতীয়করণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব কলেজের এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ সরকারি অনুদান পাওয়া) শিক্ষকরাও সরকারি হবেন। তবে তাদের অবস্থান ও পদমর্যাদা কী হবে, সে সংক্রান্ত নতুন বিধিমালা না হওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত একাধিক শিক্ষক সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বেসরকারি কলেজগুলোতে যেনতেনভাবে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এখন শুধু জাতীয়করণ হওয়ার সুবাদে বিসিএস পরীক্ষা ছাড়াই যদি এসব শিক্ষক সরাসরি ক্যাডারভুক্ত হন এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পান, তা হলে মেধাবীদের সঙ্গে বৈষম্য করা হবে। আগে দু-একটি করে কলেজ জাতীয়করণ হতো। সেগুলোতে শিক্ষকও ছিলেন কম। তাই বিষয়টি বিপর্যয়কর ছিল না। কিন্তু একসঙ্গে ২৮৩টি কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষককে ক্যাডারভুক্ত করা হলে তা পুরো শিক্ষা ক্যাডারের জন্য বিপর্যয়কর হবে।

জানতে চাইলে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সংগঠন 'বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি'র সভাপতি আই কে সেলিমউল্লাহ খন্দকার সমকালকে বলেন, বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে বিসিএসের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে মেধার যোগ্যতায় উত্তীর্ণরা শিক্ষা ক্যাডারে আসেন। এ ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই হাজার হাজার শিক্ষক ক্যাডারভুক্ত হবেন কেমন করে? তিনি বলেন, এসব শিক্ষকদের অনেকে এখনও সরকারি এমপিওভুক্তই হতে পারেননি। কলেজগুলোর বেশিরভাগই ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। ক্যাডারভুক্ত করা হলে সেসব কলেজের পাঠদানকারীরা বদলি হয়ে এসে কীভাবে অনার্স-মাস্টার্স কলেজে পড়াবেন? যোগ্যতার প্রশ্নে তারা কোনোভাবেই ক্যাডারভুক্ত হতে পারেন না। এই শিক্ষক নেতা আরও বলেন, এ শিক্ষকদের ক্যাডারের বাইরে রেখে সরকার তাদের যা খুশি সুযোগ-সুবিধা দিক, আমাদের আপত্তি নেই।

সরকারি হতে যাওয়া কলেজ শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক জহুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, যেহেতু সরকারই কলেজগুলো জাতীয়করণ করছে, তাই তাদেরও আগের মতো ক্যাডারভুক্ত করে আত্তীকৃত করতে হবে। তিনি বলেন, যে গতিতে সরকারিকরণের কাজ শুরু হয়েছিল বর্তমানে সেই গতি নেই। ফলে সরকারি হতে যাওয়া কলেজগুলোতে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিচ্ছে। শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ও ভাবাচ্ছে সবাইকে। তিনি বলেন, '১৯৭৮ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হয়ে আসছে। তখন থেকেই কলেজ শিক্ষকরা ক্যাডার মর্যাদা পেয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের একটি উপহার ঘোষণার পর হঠাৎ করে বিসিএস শিক্ষক সমিতি 'নো বিসিএস, নো ক্যাডার' আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের এ দাবি অনৈতিক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য : এমন মুখোমুখি অবস্থান ও পাল্টিপাল্টি কর্মসূচির মধ্যে পদমর্যাদা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সমকালকে বলেন, 'বিষয়টির যৌক্তিক সমাধান করা হবে। কোনো সিদ্ধান্তের কারণে বিসিএস শিক্ষকদের ক্ষতি হবে, তা চাই না। আবার আত্তীকরণ হতে যাওয়া শিক্ষকরা কোনোভাবে বঞ্চিত হবেন, তাও আমাদের কাম্য নয়। আমরা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে সমাধানের পথ খুঁজছি।'

 

http://samakal.com/bangladesh/article/17111195