১৯ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:৫২

উড়াল সড়ক নয় সমাধান বিআরটি

উড়াল সড়ক উপকারী না আত্মঘাতী-৪

উড়াল সড়কের মাত্র বিশ ভাগের এক ভাগ ব্যয়ে ঢাকার যানজট সমস্যার চিরতরে সমাধান সম্ভব। আর এ পদ্ধতিটির নাম বিআরটি। অর্থাৎ উড়াল সড়কের সাথে এর প্রধানতম তফাৎ হচ্ছে, উড়াল সড়ক যানজটকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করে। অপর দিকে বিআরটি প্রাইভেট যানবাহন কমিয়ে যানজট সৃষ্টিই হতে দেয় না। দ্বিতীয়ত ব্যয়ের ক্ষেত্রেও উভয়ের ব্যবধান আকাশ-পাতাল।

বিশেষজ্ঞদের মতে যে এলাকায় উড়াল সড়ক নির্মাণ হয় সেখানে সাময়িকভাবে সুফল পাওয়া গেলেও যানজট পরিস্থিতিকে দুষ্টচক্রে আবদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত এর সমাধান করতে একের পর এক উড়াল সড়ক নির্মাণ করতে হয়। বিশ্বের অনেক শহরে এ জাতীয় ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু যানজট থেকে আর মুক্তি মেলেনি। তাই যানজট নিরসনে ব্যয়বহুল উড়াল সড়ক নীতি পরিত্যাগ করে বাস র্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটির দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
বিআরটি হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে শুধু বাসের জন্য শহরের বিভিন্ন সড়কে আলাদা একটি লেন ঠিক করা থাকবে। এ লেনে অন্য কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। বাসগুলো প্রচলিত বাসের চেয়ে তিন-চারগুন বড় হয়। বাস স্টপেজে আসা মাত্র পুরো বাসের এক পাশ পুরো খুলে যায় এবং মুহূর্তে কয়েক শ’ যাত্রী ওঠানামা করতে পারে। একে বিকল্প রেলও বলা যেতে পারে। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের একটি সমীক্ষায় দেখানো হয়েছেÑ বাস চলাচল করে ঢাকার এমন সব সড়কেই বিআরটি চালু করা সম্ভব।

বিআরটি পদ্ধতি ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম ব্রাজিলের কুরিটিভায় চালু হলেও এ প্রসঙ্গ আসলে সবার আগে আসে কলাম্বিয়ার রাজধানী বগোতার কথা। কারণ বিআরটি চালুর আগে বগোতায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। যানজট আর বিশৃঙ্খলার কারণে শহরটি অচল হতে বসেছিল। যানজট নিরসনের জন্য বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল পাতাল রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের; কিন্তু বগোতার মেয়র এনরিক পেনালেসা দেশী-বিদেশী সব চাপ উপেক্ষা করে গণমানুষরে সুবিধার কথা চিন্তা করে যানজট নিরসনের সহজ পদ্ধতি বিআরটি চালু করলেন ২০০০ সালে। যে টাকা দিয়ে ১৭ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল সে টাকা দিয়ে ৩৮৮ কিলোমিটার বিআরটি স্থাপন করলেন। এর ফলে অতি দ্রুত শহরের ট্রাফিক-ব্যবস্থা একটি শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরে আসে এবং যানজট দূর হয়। এভাবে পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এনরিক পেনালেসা আজ বিশ্বে একটি নজির।

বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ইরান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের শতাধিক শহরে সাফল্যের সাথে চালু রয়েছে বিআরটি পদ্ধতি। যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে স্বল্প খরচে খুবই সফল পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত এ পদ্ধতি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।
বিশ্বের অনেক জনবহুল শহরে কয়েক স্তরবিশিষ্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে রয়েছে; কিন্তু তারপরও সেসব শহরে যানজট কমেনি। ফলে এগুলো তাদের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইচ্ছা করলেও ভাঙতে পারছে না তারা। এসব উন্নত দেশ লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পর কোনো সুফল না পেয়ে এখন আবার পাবলিক পরিবহনের দিকে মনোনিবেশ করেছে; কিন্তু এসব থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের কিছু কিছু দেশ উন্নত বিশ্বের ভুল পথ অনুসরণের পরিকল্পনা নিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে ঢাকায়ও একসময় এসব উড়াল সড়ক বোঝা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, যদি এখনই যানজট নিয়ন্ত্রণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়।
ঢাকায় যানজট নিরসনের জন্য ২০০৮ সালে উদ্বোধন করা হয় ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। এতে অন্য আরো অনেক বিষয়ের সাথে ঢাকায় ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে তিনটি উড়াল সড়ক এবং ৫৩ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।

রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ব্যয়বহুল উড়াল সড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দরকার নেই বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা। বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটিই হতে পারে এর একটি সহজ সমাধান।
একের পর এক উড়াল সড়ক প্রকেল্পর বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবুল বারী বলেন, এভাবে চলতে থাকলে নগর পরিবহনে বিপর্যয় নেমে আসবে, যা থেকে আর সহজে বের হয়ে আসা যাবে না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে যে সমস্যা দেখা দেবে তা সামাধানে একের পর এক আরো অনেক এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিতে হবে; কিন্তু সমাধান আর হবে না এবং নগর পরিবহন ব্যবস্থা একটি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর নজির রয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য পরিকল্পনাবিদেরা সহজ পথে না গিয়ে খারাপ ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের। বিশ্বের অনেক শহরে অনেক স্তরবিশিষ্ট উড়াল সড়ক রয়েছে; কিন্তু একই সাথে সেসব শহরে তীব্র যানজটও রয়েছে। উড়াল সড়ক দিয়ে তারা যানজট সমাধান করতে না পারলেও আমাদেরকে সে দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ড. বারী বলেন, আমরা অনেক কিছু করি আমাদের ‘মনে হয়’ তার ভিত্তিতে। পরে দেখা যায় এটি করা ঠিক হয়নি। এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়েও নির্মিত হতে যাচ্ছে মনে হওয়া বা ধারণার ভিত্তিতে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/269661