১৯ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:৪২

কথা কম কাজ বেশি

তৃতীয় নয়ন

মীযানুল করীম
গত বৃহস্পতিবার একটি বহুলপ্রচারিত দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত রিপোর্টের শিরোনামÑ ‘একেকজনের একেক কথা’। বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন ও পর্যালোচনা ছাপা হয়েছে। ‘কথা বেশি, কাজ কম’Ñ আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। নির্বাচন কমিশন বা ইসিকেও এই ব্যামো যদি ধরে, তাহলে তাদের আসল কাজ তথা সুষ্ঠু নির্বাচন বিঘিœত হবে। তখন সুযোগসন্ধানীরা ফায়দা লুটবে। একজন পর্যবেক্ষকের ভাষায়Ñ ‘রাজনীতিবিদদের মতোই অতিকথন শুরু করেছেন নির্বাচন কমিশনারেরা। কমিশনে নিয়োগ পাওয়ার মাত্র ৯ মাসের মাথায় বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে হুদা কমিশন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে বসে এমন অতিকথনে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে।’

ব্যাপার হলো, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী তিনজন বলেছেন তিন রকমের কথা। মাঝে মাঝে সিইসি এবং কমিশন সচিবও একই ইস্যুতে একাধিক ধরনের উক্তি করেছেন। প্রতিদিন মিডিয়াকে কিছু বলতেই হবে অথবা সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে লম্বা জবাব দেয়া দরকারÑ এমন মনে করা ভুল। এ দিকে দেশের মানুষ মনে করছে, ‘সিইসি সমেত নির্বাচন কমিশনারদের মাঝে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে না।’ কিন্তু তারা একমত না হলে তো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না। এ দিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে আর জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এখন নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রতিটি দিন, প্রতিটি উক্তিই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মিডিয়ার খবর, আলোচিত বর্তমান সিইসি কে এম নূরুল হুদার সাথে অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার বা ইসি এবং কমিশন সচিবের মতবিরোধ শুধু যে আছে, তা নয়Ñ এটা রীতিমতো বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস এবং দক্ষতা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হচ্ছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সম্প্রতি তাকে না জানিয়েই কমিশনের একদল মাঠ কর্মকর্তার রদবদল ঘটানো হয়েছে। এ কারণে তিনি কমিশন সচিবকে তার আপত্তি জানিয়েছেন। অপর দিকে, সিইসি নূরুল হুদা বলেছেন, ‘ইসি সচিবালয় কর্মকর্তাদের বদলি ও পদোন্নতির ব্যাপারে এই কমিশনের কোনো এখতিয়ার নেই। এটা ইসি সচিবালয়ের এখতিয়ার।’
নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয় বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুব গুরুত্ববহ ব্যাপার বিধায় সবার নজর এ দিকে। গত সোমবার এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হবে।’ আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বললেন, ‘বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন করার বিষয়ে এখনো কমিশন চিন্তাভাবনা করছে।’ আর খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা বুধবার বলেছেন, ‘নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়নি। মাহবুব তালুকদার মনে করেন, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন দরকারÑ এটা তার ব্যক্তিগত মত।’

ইভিএম নিয়েও একাধিক ধরনের বক্তব্যে বিতর্ক জন্ম নিয়েছে। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হুদা কমিশনের জন্য প্রথম বড় পরীক্ষা। নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন, ‘রংপুরে পুরনো ইভিএম ব্যবহার করা হবে। অনলাইনে এই নির্বাচনের মনোনয়নপত্র পেশ করা যাবে।’ কিন্তু তফসিল ঘোষণাকালে সিইসি বলেছেন এর বিপরীত। তার কথা, ‘নতুন ইভিএম ব্যবহার করা হবে নির্বাচনে। অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে না।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসেন বলেছেন, “নির্বাচন কমিশনারদের মাঝে ঐক্য ও সমন্বয় অবশ্যই থাকা চাই। বক্তব্য দেয়ার সময় খুব সচেতন থাকতে হবে। অন্যথায় অসুবিধা হতে পারে। তারা একেকজন একেক কথা বললে হবে না। কমিশনে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই কোনো বিষয়ে কথা বললে মানুষ ভুল বুঝবে। শুধু সিদ্ধান্তই প্রকাশ করা উচিত। অন্য দিকে কোনো নির্বাচন কমিশনার যখন বলেন, কমিশনের পক্ষেই বলেন। এটাকে ‘ব্যক্তিগত মত’ বললে হবে না। একজন কমিশনারের বক্তব্যকে গোটা নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য বলে ধরে নিতে হবে। এই কমিশনের সবাই একমত হয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা ঠিক নয়।”
দেশের সচেতন ও গণতন্ত্রকামী নাগরিকেরাও এটাই মনে করেন। নির্বাচন কমিশনের নিজেদের ঐক্য ও সমন্বয় না থাকলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হবে। সময়মতো পদক্ষেপ নিতে এই কমিশনের ব্যর্থতায় জাতি আরো সঙ্কটে পড়বে। তাই এখনই সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ হয়ে যাওয়া উচিত। মনে রাখা দরকারÑ ‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার’।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন অনেক আগে থেকেই দ্বিধাবিভক্ত। দ্বিদলীয় রাজনীতি নাকি উন্নত বিশ্বে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশে বিরাট অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে এ রাজনীতির অপপ্রয়োগে সংসদ অকার্যকর এবং গণতন্ত্র বিপন্ন। আমরা যে উন্নত বিশ্বের অংশ আজো হতে পারিনি, এর একটি প্রমাণ এই দুরবস্থা। যা হোক, এখন জাতীয় রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো, সামনের সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন কিভাবে, কার অধীনে হবে, তা নিয়েও আমাদের মাঝে বিরাট বিভাজন। সরকার তার গোঁ ধরে আছে; বিরোধী দলও নিজ দাবিতে অনড়। কথায় বলে, ‘ভদ্রলোকের এক কথা।’ আমরা কি এতই ভদ্র হয়ে গেলাম যে, নিজেদের কথায় ‘নট নড়ন চড়ন’! বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের আচরণ আর দেশের হালফিল অবস্থা দেখে বলতে হয়, আমাদের রাজনীতিতে ভদ্রতা নেই। এখন সর্বত্র অভদ্রদের জয়জয়কার।

সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। এটা শুধু ভিন্ন মত নয়; একেবারে পরস্পরবিরুদ্ধ মত। ক্ষমতায় যারা আছেন, তারা সংসদ নির্বাচনের সময়েও বহাল তবিয়তে থাকতে চান। তারা সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিপক্ষে এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পক্ষে। এর বিপরীতে, বিরোধী দল চায়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। তারা সেনা মোতায়েনের পক্ষে এবং ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। এসব মতামত সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সাথে দলগুলোর সংলাপে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন বল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কোর্টে। জনগণের প্রত্যাশা মোতাবেক, জাতীয় স্বার্থে এবং কারো মুখের দিকে না চেয়ে তাদের যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্ররূপ প্রাসাদের ভিত্তি। একে দৃঢ়মূল করাই ইসির দায়িত্ব। দৃঢ়তা কিংবা দূরদৃষ্টির অভাবে ইসি যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবে। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ইসির সন্দেহাতীত ঐক্য, যাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তার সহকর্মী কমিশনারেরা এক সুরে অভিন্ন বক্তব্য রাখেন। বলছিলাম, বল এখন ইসির কোর্টে। ইসির শীর্ষ দায়িত্বশীলদের সাবধান থাকতে হবে, বলটি দিয়ে যাতে আত্মঘাতী গোল না হয়। গত কয়েক দিনে খোদ ইসি নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে জনগণ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এখানে জাতির মাঝে ঐক্য নেই। এখন (আল্লাহ না করুন) স্বয়ং নির্বাচন কমিশনে অনৈক্য দেখা দিলে তাদের পরিচালিত নির্বাচন জাতীয় ঐক্যের সম্ভাবনা নয়, বিভাজনের শঙ্কাই বাড়িয়ে দেবে।
ভারত নিকট অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন ও সরকারের ব্যাপারে অনেক কলকাঠি নেড়েছে এবং কারসাজি করেছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এ দেশে তার ‘মনমতো গণতন্ত্র’ চাইলেও ভারত নিজের ক্ষেত্রে কিন্তু গণতন্ত্রচর্চা তথা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ে তোলার ঐতিহ্য অনেকটাই স্থাপন করতে সফল হয়েছে। ভারতের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের সুদৃঢ় ও সাহসী ভূমিকা এর একটি বড় নজির। কয়েক বছর আগে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন টি এন সেশান। ইসির স্বাধীন ও সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তার নাম স্মরণীয়। শুধু ইসি বা নির্বাচন কমিশন চাইলেই হয়তো শতভাগ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায় না; তবে ইসি তার আইনি ক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগালে নির্বাচন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ ও গ্রহণীয় হবে। এ জন্য কমিশনের সততার সাথে সাহস, দায়িত্বনিষ্ঠার পাশাপাশি দৃঢ়তা অপরিহার্য। আমাদের দেশে ইসিতে অনেক কমিশনারই ছিলেন দক্ষ ও অভিজ্ঞ, ছিলেন ‘ভালো মানুষ’ও। কিন্তু যে কারণেই হোক, কার্যত দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে সাহসের সাথে তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ফলে নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। অথচ আমাদের সংবিধানে ইসিকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেটা কাজে লাগালে নির্বাচন অনেকটাই সুষ্ঠু হতে পারে।

একসময়ে নির্বাচন কমিশন সরকারের নিয়ন্ত্রণের নিগড়ে ও নিজেদের দুর্বলতায় জন-আস্থা এতটাই হারিয়ে ফেলে যে, এককালের সিইসি বিচারপতি সাদেকের নামে ব্যঙ্গ করে বলা হতোÑ ‘সাদেক আলী মার্কা নির্বাচন’। কিন্তু পরবর্তীকালের সিইসিদের ক’জন জনগণের প্রত্যাশা পূরণ কিংবা সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন? এ প্রসঙ্গে ‘নির্বাচিত’ সরকার আমলের সর্বশেষ সিইসির দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। গত কয়েক বছরে এই সিএসপি আমলার নেতৃত্বে ইসির সাফল্যের মাপকাঠি হলোÑ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অদ্ভুত সংসদ নির্বাচন এবং ‘ফাটাফাটি’ উপজেলা নির্বাচন। এসব নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য যুগপৎ প্রহসন ও ট্র্যাজেডি হিসেবে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রকে এক প্রকার নির্বাসন দিয়েছে বলা অত্যুক্তি হবে কি? এ অবস্থায় ‘রকিব আলী মার্কা নির্বাচন’ আর যাতে দেশে না হয়, তা নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের তাগিদ এবং গণতন্ত্রের শুভাকাক্সক্ষীদের তাগাদা।
মেরুদণ্ড সমাচার ও ছি: ছি:
‘মেরুদণ্ড’ কথাটির ভাবার্থ সবার জানা। মানুষের ‘মেরুদণ্ড’ থাকার তাৎপর্য তার নিছক মেরুদণ্ডী প্রাণী হওয়ার চেয়ে অনেক উন্নত ও গভীর অর্থ বহন করে। বিগত ইসির সময়ে নির্বাচনের নামে বেনজির ভোট ডাকাতি, জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের দেশব্যাপী তাণ্ডবে ইসিকে যথার্থই বলা হয়েছিল ‘মেরুদণ্ডহীন’। এর প্রতিবাদে একজন নির্বাচন কমিশনার তার অফিসে সাংবাদিকদের সামনে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেনÑ ‘দেখুন, আমাদের মেরুদণ্ড আছে।’ এমন ‘বীরপুরুষ’দের জানিয়ে দেয়া যেত, পশু ও সরীসৃপসহ অনেক মানবেতর প্রাণীরও মেরুদণ্ড আছে। মেরুদণ্ডের এক নাম ‘শিরদাঁড়া’। যে মানুষ নীতিনিষ্ঠার বলে শির উঁচু করে চলতে পারে না, তার মেরুদণ্ড থাকা না থাকা এক কথা।

সিইসি, অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদ। যে দেশে গণতন্ত্র পর্যবসিত হয়েছে দলতন্ত্রে, যেখানে নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে গণতন্ত্রের চেতনা নির্বাসিত এবং আইনের শাসনের নামে গোষ্ঠীবিশেষের কর্তৃত্ববাদ কায়েম হয়েছে, সে দেশে সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কত বড়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ দেশে নির্বাচন কমিশনকে ‘সাক্ষীগোপাল’ কিংবা ‘নিধিরাম সরদার’ গোছের ভূমিকা দেখে মানুষ ক্ষোভে দুঃখে সিইসি-কে ‘ছি: ছি:’ বলে ধিক্কার দিয়েছিল। তারা এ কারণে লজ্জিত হয়েছেন কি না জানি না, তবে এ লজ্জা জাতির, গণতন্ত্রের, বাংলাদেশের।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/269520