১৮ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:৩২

মাধ্যমিকে ৪০% শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ে

প্রাথমিক পেরিয়ে মাধ্যমিক স্তরে যে শিক্ষার্থীরা আসে তাদের ৪০ শতাংশই ঝরে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি হিসাবেই। তবে বাস্তবে ঝরে যাওয়ার হার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
পরিসংখ্যান উল্লেখ করে শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ শিশু স্কুলে এলেও সমাপনীতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, গড়ে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে যাওয়ার হার গড়ে ২১ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে ঝরে যাওয়ার হারে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে মাধ্যমিক।

এর কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রাথমিকে শিশুকে স্কুলে আনতে উপবৃত্তির পাশাপাশি স্কুল ফিডিংসহ নানা কর্মসূচি আছে। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে মেয়েদের উপবৃত্তি ছাড়া তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ঝরে যাওয়ার পেছনে আরো কয়েকটি কারণ খুঁজে বের করেছেন শিক্ষাবিদরা। এর অন্যতম দারিদ্র্য ও মেয়েদের বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া দুর্বোধ্য সৃজনশীল পদ্ধতিতেও অনেক শিক্ষার্থী তাল মেলাতে পারছে না। আর মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্বের কারণেও গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া বাদ দিচ্ছে বলে উল্লেখ করছেন শিক্ষাবিদরা।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০.২৯ শতাংশই এসএসসি পরীক্ষার আগে ঝরে যায়। ওই সময় এই স্তরে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ৭২ জন। এর মধ্যে ৫১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬২ জন ছাত্রী। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি ছিল। ছাত্রীদের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছে ৫৪.৮ শতাংশ এবং ছাত্রদের মধ্যে এই হার ৬৬.২৮ শতাংশ।
ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়েছে প্রায় ২০.৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। একই বছর উচ্চ মাধ্যমিকে এই হার ছিল গড়ে ২০.০৮ শতাংশ।
তবে শিক্ষাবিদরা পরিসংখ্যান দিয়ে বলছেন, ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রাথমিক সমাপনী ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ লাখ। এদের মধ্যে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী দ্বিতীয়বারের মতো এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেই হিসাবে মাধ্যমিকেই ঝরে যাচ্ছে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণেই মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীরা বেশি ঝরে পড়ে। বাল্যবিয়ে ও প্রতিষ্ঠানের দূরত্বও অন্যতম কারণ। ’
ঝরে পড়ার হার কমাতে নেওয়া উদ্যোগের কথা জানিয়ে ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা মাধ্যমিক পর্যায়েও উপবৃত্তি দিচ্ছি। শিক্ষকদের দক্ষ করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতা সৃষ্টিতেও কাজ করা হচ্ছে। ঝরে পড়া রোধের কারণগুলো খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ’
সৃজনশীল পদ্ধতি যে দুর্বোধ্য সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে খোদ মাউশি অধিদপ্তরের চলতি বছরের জরিপেও। অধিদপ্তরের একাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫২.০৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো সৃজনশীল বোঝেন না। এর মধ্যে ৩০.৮৯ শতাংশ শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। আর সমিতি থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ২১.১৭ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নের এলাকাভিত্তিক তথ্যে দেখা গেছে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছেন বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষকরা। এই অঞ্চলের ৭৯.২৪ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকই নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না।
তবে ঢাকা বিভাগেরই ৫২.৫১ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগের ৭৬.৫৫, সিলেটে ২৮.১৪, চট্টগ্রামে ৫০.৯৪, রংপুরে ৫০.৫২, রাজশাহীতে ৪৬.৫৬, খুলনায় ৩৫.১২, বরিশালে ৭৯.২৪ এবং কুমিল্লায় ২৭.১৮ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেখানে শিক্ষকরাই সৃজনশীল বোঝেন না, সেখানে শিক্ষার্থীরা কিভাবে বুঝবে? তবে যেসব শিক্ষক সৃজনশীল বোঝেন তাঁদের কাছে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা প্রাইভেট-কোচিং পড়ে। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা সেটি না পারায় একসময় তাল মেলাতে না পেরে ঝরে পড়ে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিকে এখন মেয়েদের ভর্তির হার ছেলেদের তুলনায় বেশি। মাধ্যমিকের শুরুতে একই অবস্থা থাকে। কিন্তু এসএসসিতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেদের হার বেশি। এর একটা বড় কারণ মেয়েদের বাল্যবিয়ে। আবার মেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছলে অনেক পরিবারই নিরাপত্তার কারণে আর স্কুলে পাঠায় না। ফলে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে মেয়েদের সংখ্যা কমতে থাকে।
আর ছেলেদের ঝরে পড়ার কারণ উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ছেলেদের ক্ষেত্রে পরিবারের অনীহা অন্যতম কারণ। স্কুলে না গিয়ে জমিতে কাজ করলে পরিবারের আর্থিক সহায়তা হয়, তা ভেবেই অনেক ছেলে স্কুল বাদ দেয়। এ ছাড়া শিক্ষাব্যয় নির্বাহ করতে না পেরেও অনেক পরিবার সন্তানের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও মিরপুরের সিদ্ধান্ত হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম রনি কালের কণ্ঠকে বলেন, মেয়েদের স্কুলে আসার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বড় বিষয়। এ ক্ষেত্রে এলাকাবাসীকে সচেতন হতে হবে। শিক্ষকরাও ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষ করে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা যদি বিষয়টির নিয়মিত তদারকি করে তাহলে বখাটেদের কারণে কোনো মেয়ের স্কুলে আসা বন্ধ হবে না।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/11/18/566925