১৮ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:৩১

অনৈতিক সম্পর্কের মূল্য দিচ্ছে শিশুরা

সাড়ে সাত বছর আগে রাজধানীর আদাবরে শিশু সামিউল আজিমকে হত্যা করা হয়। সেই মামলার বিচার এখনও চলছে। প্রধান আসামি শামসুজ্জামান ওরফে আরিফ ওরফে বাক্কু উচ্চ আদালত থেকে জামিনের পর পলাতক রয়েছে। অপর আসামি সামিউলের মা আয়শা হুমায়রা এশার সঙ্গে শিশুটির বাবা খন্দকার আজম নতুন করে সংসার শুরু করেছেন। প্রায় পাঁচ বছর কারাভোগের পর আজমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে আদালত আয়শাকে জামিন দেন। আরিফের সঙ্গে মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় ২০১০ সালের ২৩ জুন সামিউলকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই বছরের জুলাইয়ে খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগে মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের কারণেই সাড়ে তিন বছরের জেনিফা ইসলাম তানহা খুন হয়। মা হালিমা ইসলাম তমার সহায়তায় প্রেমিক রেজাউল করিম রাজীব ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। সেই হত্যা মামলাও বিচারাধীন।

শুধু সামিউল ও তানহা নয়, বাবা কিংবা মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের বলি হতে হয়েছে অনেক শিশুকে। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পরকীয়ার জেরে একাধিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আলোচিত ছয়টি মামলার মধ্যে চারটির বিচার চলছে। আর পুলিশ দুটির তদন্ত করছে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, বাবা বা মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের কারণে ২০১৫ সাল থেকে গত মাস পর্যন্ত ১২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। একই কারণে স্বামী কিংবা স্ত্রীকেও প্রাণ দিতে হচ্ছে। সর্বশেষ ১ নভেম্বর রাজধানীর বাড্ডায় বাবা-মেয়ে খুন হয়।

সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, নানা কারণে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হয়ে পড়ছে। এ কারণে অবিশ্বাস ও অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে, যা অনেক সময় খুনোখুনিতে রূপ নিচ্ছে।

সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, পরকীয়া সম্পর্কে জড়ানোর পর মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তখন নিজের সন্তানকেও শত্রু ভাবতে শুরু করে। এর পরই সন্তানকে খুন করে। তিনি বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা থেকে বের হতে হবে। স্বামী ও স্ত্রীকে একে অপরের সময় দিতে হবে। নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে।

মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও আইনজীবী সালমা আলী বলেন, দিন দিন সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। এ কারণেই কেউ কেউ নিজের সন্তানকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। এমন ঘটনা প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের হত্যা মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করে দোষীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে অন্যরাও এ ধরনের অপরাধ করতে ভয় পায়।

তানহা হত্যা মামলার আসামি লাপাত্তা :শিশু জেনিফা ইসলাম তানহাকে কোলে নিয়ে মা হালিমা ইসলাম তমা প্রেমিক রেজাউল করিম রাজীবের সঙ্গে ২০১০ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে স্বামীর ঘর ছাড়েন। রাজধানীর মিরপুরের স্বামীর ঘর ছেড়ে খিলগাঁও সিপাহীবাগে বাসা ভাড়া নিয়ে নতুন সংসার শুরু করেন। দু'দিন না যেতেই ছোট্ট শিশুটিকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে রেস্টুরেন্ট কর্মচারী রাজীব। এর পরই হালিমার সহায়তায় সে তানহাকে হত্যা করে। ৪ আগস্ট ওই বাড়ির কার্নিশে শিশুটির গলিত লাশ পাওয়া যায়। তানহার বাবা গাজী ফারুক হোসেনের মিরপুরের মুদি দোকানি। স্ত্রী ও রাজীবের বিরুদ্ধে তার করা মামলাটি বিশেষ জজ আদালত-১-এ বিচারাধীন। ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে রাজীব আত্মগোপনে রয়েছে। গত বছরের ৬ নভেম্বর জামিনে মুক্ত হয়েছেন হালিমা। এ মামলায় ১৯ জনের মধ্যে ৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

বিচারাধীন নিহাল হত্যা মামলা :স্বামী-স্ত্রী দু'জনই দু'জনকে সন্দেহ করত। সন্দেহের বিষয় পরকীয়া। এ নিয়ে শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। এর জের ধরে গত বছরের ১৮ এপ্রিল দেড় বছরের ছেলে নিহাল সাদিককে বঁটি দিয়ে কেটে হত্যা করে মা ফাহমিদা মীর মুক্তি। মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডটি ঘটে রাজধানীর উত্তরখানের মাস্টারপাড়ায়। বিশেষ জজ আদালত-২-এ বিচারাধীন এ মামলায় একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। ৩০ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

তিন ভাই হত্যা মামলার তদন্ত চলছে :সাভারের হেমায়েতপুরে পরকীয়া প্রেমিক কেরু মানিকের প্ররোচনায় ভাতের সঙ্গে বিষ খাইয়ে নিজের দুই ছেলে জীবন ও নাসির এবং ননদের ছেলে শাহাদাতকে হত্যা করে নাসরিন বেগম। এই হত্যাকাণ্ড ঘটে গত বছরের ১৪ মে। নাসরিন ও কেরু মানিককে গ্রেফতার করেছের্ যাব। সাভার থানা পুলিশের পর এখন মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা জেলার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইর পরিদর্শক একেএম নাসির উল্লাহ বলেন, মানিকের সঙ্গে নাসরিনের অনৈতিক মেলামেশা দেখে ফেলেছিল তার স্বামী জিয়াউর রহমান ও বড় ছেলে জীবন। এ কারণেই হত্যার ঘটনা ঘটে। হেমায়েতপুরের একটি ডেইরি খামারের তত্ত্বাবধায়ক জিয়াউর স্ত্রী, দুই সন্তান ও ভাঘ্নে শাহাদাতকে নিয়ে সেখানেই থাকতেন।

মিরপুরে মা-ছেলে খুন :পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ আমান। এ নিয়ে স্ত্রী আইরিন আক্তার আরজুর সঙ্গে শুরু হয় কলহ। স্ত্রীর পাশাপাশি ছেলে সাবিদকেও পথের কাঁটা ভাবতে শুরু করেন আমান। ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় মিরপুরের মধ্যপাইকপাড়ায় ঘরের মধ্যে সাবিদকে গলাটিপে ও স্ত্রী আইরিনকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন তিনি। মিরপুর থানায় আইরিনের চাচা ইউনুস হাওলাদারের করা মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আমানকে অভিযুক্ত করে ২০১৫ সালের এপ্রিলে আদালতে চার্জশিট দেয়। এদিকে আমান নিজে স্ত্রী ও ছেলে হত্যার ঘটনায় কারাগার থেকেই আরও একটি মামলা করেন। এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এরপর পুনঃতদন্তের দাবি করে আদালতে আবেদন করেন। পুনঃতদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে করা মামলাটির স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন তিনি। সিআইডি আমানের করা মামলাটি পুনঃতদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর উচ্চ আদালত ওই মামলার স্থগিতাদেশ বাতিল করেন। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান জানান, স্থগিতাদেশ বাতিলের কপি পেয়েছেন। রোববার ট্রাইব্যুনালে পেশ করা হবে। এর পরই বিচারকাজ শুরু হবে।

নতুন সংসার পেতেছে সামিউলের বাবা-মা :আদাবরে পাঁচ বছরের শিশু সামিউলকে হত্যার পর লাশ ফ্রিজে ঢোকানো হয়। পরের দিন বস্তায় ভরে রাস্তায় ফেলা হয়। এ ঘটনার পর খন্দকার আজম বাদী হয়ে স্ত্রী আয়শা ও আরিফকে আসামি করে আদাবর থানায় মামলা করেন। আরিফ ও আয়শা হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়। ২০১১ সালের শেষের দিকে দু'জনকে অভিযুক্ত করে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। মামলাটি বিশেষ জজ আদালত-৪-এ বিচারাধীন। ৩১ সাক্ষীর মধ্যে ২১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

এদিকে আয়শা হুমায়রা এশার সঙ্গে খন্দকার আজম নতুন করে সংসার শুরু করেছেন। প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে থাকা স্ত্রী আয়শাকে ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল নিজ জিম্মায় জামিন করেন আজম। অবশ্য জামিনের আগেও স্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষী দিয়েছিলেন আজম। কিন্তু এরপর নিজের শারীরিক অবস্থা ভালো নয় জানিয়ে আদালতে স্ত্রীর জামিনের জন্য আবেদন করেন।

'পথের কাঁটা' দূর করতে বাবা-মেয়ে খুন :বাবাকে হত্যা করতে দেখে ফেলায় মায়ের পরকীয়া প্রেমিকের হাতে খুন হয় ৯ বছরের শিশু নুসরাত জাহান জিদনী। ১ নভেম্বর রাতে উত্তর বাড্ডার ময়নারবাগের ভাড়া বাসায় নুসরাতকে শ্বাসরোধে ও তার বাবা জামিল শেখকে মাথায় আঘাত করে খুন করা হয়। জামিলের স্ত্রী আরজিনা ও তার প্রেমিক শাহীন মল্লিক হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। জামিলের সংসার ছেড়ে শাহিনের সঙ্গে 'ঘর বাঁধার' স্বপ্ন দেখছিল আরজিনা। পথের কাঁটা সরাতেই তারা খুন করে বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বাড্ডা থানার এসআই সাখাওয়াত হোসেন।

রঙমিস্ত্রি শাহীন নিহত জামিলের ভাড়া বাসার একটি কক্ষে স্ত্রী মাসুমাকে নিয়ে সাবলেট থাকত। হত্যায় জড়িত সন্দেহে শাহীনের স্ত্রী মাসুমা ও বন্ধু কোয়াজকেও গ্রেফতার করা হয়।

http://samakal.com/bangladesh/article/17111135