১৮ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:১৫

আত্মঘাতী পরিবহন পরিকল্পনার নেপথ্যে

উড়াল সড়ক উপকারী না আত্মঘাতী

ঢাকায় যানজট নিরসনে ২০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এর নাম কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লান, এসটিপি)। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট উদ্বোধন করা হয় এসটিপি। এসটিপি প্রণয়নে তখন খরচ হয় ১৫ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক দেয় এ টাকা ঋণ হিসেবে। বিশ্বব্যাংকের শর্তানুযায়ী মার্কিন কোম্পানি লুইস বার্জার প্রণয়ন করে এ পরিবহন মহাপরিকল্পনা।

এসটিপি মূল্যায়নের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩২ সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয় তখন। প্রাইভেট কার আমদানিকারক, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাবেক রাষ্ট্রদূত, এমপি, সাংবাদিক, রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানসহ প্রায় ২০ জন সদস্য ছিলেন এ উপদেষ্টা কমিটিতে, যাদের নগর পরিবহন পরিকল্পনা বিষয়ে কোনো ধারণা নেই।
এসটিপি সংশোধন (রিভাইজড) করে পরে এর নাম রাখা হয় আরএসটিপি। বর্তমানে ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ যানজট নিরসনে যেসব বিলাসবহুল বিতর্কিত প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে তার অনেক কিছু রয়েছে এই এসটিপি আরএসটিপিতে। এসটিপি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং তখন এর বাস্তবায়ন ব্যয় হিসাব করা হয় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তবে তখনই অনেকে এর বাস্তবায়ন ব্যয় ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এসটিপি প্রণয়নে সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিল ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড ডিটিসিবি। বর্তমানে নগর ভবনে অবস্থিত এ সংস্থার নাম ডিটিসিএ।
লুইস বার্জার প্রণীত এসটিপিতে বাস নির্ভর পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থা বিআরটির (রাস্তায় বাসের জন্য আলাদা একটি লেন তৈরি করা হবে যেখানে অন্য কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না) প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ছাড়া হাঁটাকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থার প্রতিও গুরুত্ব ছিল। নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল প্রাইভেট কার নির্ভর যাতায়াত। উড়াল সড়ক, পাতাল রেলের প্রতিও তাদের আগ্রহ ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, উপদেষ্টা কমিটির অনেক সদস্য, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এতে নাখোশ হন। সরকারের অনেকে অতি উৎসাহী ছিলেন উড়াল সড়ক, পাতাল রেলের মতো বিলাসী পরিকল্পনার প্রতি। তা ছাড়া প্রাইভেট কারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার নীতিতেও অখুশী হন কেউ কেউ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসটিপির উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য বলেন, এসটিপির পরিকল্পনা একেবারে খারাপ ছিল না। কিন্তু তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধা সৃষ্টি করা এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ আগে থেকেই তাদের ঠিক করা বিভিন্ন পরিকল্পনা এসটিপিতে স্থান দেয়ার ব্যবস্থা করে। তাদের কারণেই উড়াল সড়ক এবং পাতাল রেলের মতো পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এসটিপিতে। এ ছাড়া এসটিপির ওপর উপদেষ্টা কমিটির অনেক সদস্যেরও চাপ ছিল যাদের আসলে নগর পরিবহন পরিকল্পনা বিষয়ে তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না।
অভিযোগ রয়েছে, এসটিপটিতে সহজ গণপরিবহন ব্যবস্থা বিআরটিরও বিরোধিতা করেন উপদেষ্টা কমিটির কেউ কেউ। কারণ বিআরটির জন্য রাস্তার একটি অংশ শুধুমাত্র বাস চলাচলের জন্য লেন হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়। তারা যুক্তি দেখান এতে রাস্তার পরিমাণ কমে যাবে এবং সব রাস্তায় আলাদা বাস লেন করার মতো অবস্থা নেই।
উপদেষ্টা কমিটিতে প্রাইভেট কার আমদানিকারক সদস্যও ছিলেন। রাস্তায় বাসের জন্য আলাদা লেন করা হলে বাধাগ্রস্ত হবে প্রাইভেট কার চলাচলে। তাই প্রাইভেট কারের পক্ষের লোকজন বিআরটির পক্ষে থাকবে না এটিই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন এসটিপি বিষয়ক অনেক গবেষক। এসটিপি মূল্যায়নের জন্য সব শ্রেণী-পেশার লোক রাখার কথা বলে ননটেকনিক্যাল অনেক লোক রাখা হলেও বস্তুত তাদের অনেকে ছিলেন বিভিন্নভাবে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর প্রতিভূ এবং তারা তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই এসটিপি মূল্যায়ন করেছেন।

২০০৮ সালের এসটিপি স্টাডিতে দেখানো হয় তখন পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করে ঢাকার ৩৪ শতাংশ এবং প্রাইভেট কার ও ছোট যান্ত্রিক যান বর্তমানে ব্যবহার করে ১৮ শতাংশ মানুষ। আর এসটিপি বাস্তবায়নের পর ২০২৪ সাল নাগাদ ঢাকায় বাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৪ শতাংশ থেকে কমে আসবে ২১ শতাংশে। অন্য দিকে প্রাইভেট কার ব্যবহারকারী সংখ্যা ১৮ শতাংশ থেকে ৩১ শতাংশে উন্নীত হবে মর্মে স্টাডিতে দেখানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সারা বিশ্বে যেখানে প্রাইভেট কার কমিয়ে পাবলিক পরিবহনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে, ঢাকায় সেখানে পাবলিক পরিবহন কমিয়ে প্রাইভেট কারে যাত্রীবহনের হার বাড়ানোর ব্যবস্থা করে যানজট কমানোর চেষ্টা করা হয় ২০০৮ সালের এসটিপিতে। এটি উদ্ভট এবং আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছু নয়।
ঢাকার যানজট নিরসন এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে লুইস বার্জার যে ওয়ার্কিং পেপার তৈরি করে তাতে ১০টি বিকল্প কৌশল ছিল। কৌশল-১ এর জন্য মূল্যায়ন নম্বর ছিল ৩১৯ এবং কৌশল ২বি-এর মূল্যায়ন নম্বর ছিল ২৬২। কৌশল ২বি-এর অবস্থান ছয় নম্বরে। সব দিক বিচারে যেটির মূল্যায়ন নম্বর বেশি সেটিই এক নম্বরে স্থান পায়। কিন্তু মূল প্রতিবেদন যখন তারা জমা দিলো সেখানে দেখা গেল এক নম্বরের পরিবর্তে ছয় নম্বর কৌশলকে বেছে নেয়া হয়েছে যেখানে পাতাল রেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো রয়েছে। এক নম্বর কৌশলের বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর ছয় নম্বরটির ৪.৫ বিলিয়ন ডলার (বিদ্যমান রেল খাত বিনিয়োগ ব্যতীত)। কৌশল-১ এর তুলনায় কৌশল ৬-এর বাস্তবায়ন ব্যয় ২.৬ বিলিয়ন ডলার বেশি।
অভিযোগ রয়েছে কৌশল ১-এর পরিবর্তে ছয় নম্বরে অবস্থানকারী কৌশল ২বি বেছে নেয়ার পেছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের চাপ ছিল লুইস বার্জারের ওপর।

কৌশল -১ এ যানজট নিরসনে প্রাইভেট কারের বদলে পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং হাঁটাকেন্দ্রিক পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব ছিল।
এসটিপি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রফেসর ড. খ ম মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, উড়াল সড়ক নির্মাণ করে যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। এটি আমাদের জন্য গলার কাঁটা হবে। পাতাল রেল সম্পর্কে তিনি বলেন ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে সেটি বিবেচনা করে পাতাল রেলের অপশন রাখা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে উড়াল সড়ক একটি বাতিল নগর পরিবহন পরিকল্পনা। এক সময় অনেক শহরে এসব বিলাসী প্রকেল্পর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা যানজট কমাতে না পেরে পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থার প্রতি নজর দিয়েছে। অনেক উন্নত শহরে উড়াল সড়কের মাধ্যমে সুফল না পাওয়ার নজির থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ যানজট নিরসনের সহজ পথে না গিয়ে ব্যয়বহুল এসব প্রকল্প গ্রহণে উৎসাহী হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত যেসব দেশ বিভিন্ন দাতা সংস্থার খপ্পরে পড়েছে সেসব দেশই আত্মঘাতী এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে। ঋণ প্রদানকারী সংস্থা, বিভিন্ন দেশ এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও তৃতীয় বিশ্বের উঠতি দেশগুলোকে এসব প্রকল্প গ্রহণে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করে। তা ছাড়া এর সাথে জড়িত রয়েছে লুটপাট এবং বহুমুখী বাণিজ্য। ২০০৫ সাল পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশী লোন নিয়েছে পরিবহন খাতে, ৪৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপর রয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাত, ৪৪৩.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আন্তর্জাতিক পরিবহন প্রকৌশল বাংলাদেশের ড. মাহবুবুল বারি বলেন, এসটিপি ছিল প্রাইভেট কারবান্ধব এবং বিপুল জ্বালানি নির্ভর একটি পরিবহন কৌশল। ঢাকায় পাতাল রেল এবং উড়াল সড়ক আত্মঘাতী পরিবহন পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন, এসটিপিতে লং জার্নি উৎসাহিত করা হয়েছে। আর সারা বিশ্ব চেষ্টা করছে শহরে লং জার্নি নিরুৎসাহিত করতে। কেউই শহরে লং জার্নি চায়না। কারণ এতে সময় এবং অর্থ বেশি লাগে। দূষিত হয় পরিবেশ। তাই সবাই কর্মস্থলের কাছাকাছি বাস করতে চায়। সেজন্য বিশ্বের অনেক শহরে মিশ্র এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে বাসস্থানের কাছেই অফিস, বাজার, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল এবং বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে লোকজন হেঁটে বা সাইকেলে সামান্য পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/269347