১৮ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৩৬

আজকাল হুকুমতো নড়েই হাকিম ভেগে যায়

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : আগে পাঠ্যপুস্তকে খুব মশহুর একটি প্রবাদবাক্য ছিল। সবাই পড়েছেন। আমরা পড়েছি। আপনারা পড়েছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ছে। নাতি-নাতনিরাও পড়বে। এখনও এটি পাঠ্যবই থেকে মুছে ফেলা হয়নি। মানে এখনকার দিনের এই অসত্য বাক্যটি নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে বাংলাভাষী কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীকে পাঠ্যবইয়ে পড়তে হয়েছে। লিখতে হয়েছে পরীক্ষার খাতায় ভাবসম্প্রসারণ। কেউ লিখতে ব্যর্থ হলে নম্বর কমে গেছে। হয়তো অনেককে এজন্য পরীক্ষায় ফেল করিয়েও দেয়া হয়েছে। কী সেই প্রবাদবাক্যটি বুঝে উঠতে পেরেছেন কেউ? মনে হয় না। যাকগে, ভণিতা না করে বলেই ফেলি। মহাজন বাণীটি হচ্ছে, ‘হাকিম নড়েতো হুকুম নড়ে না।’ কী, মনে পড়ছেতো? নিশ্চয়ই মনে পড়ছে এবার।
এখন বলুন, এতোদিন এ প্রবাদবাক্যের ভাবসম্প্রসারণ অথবা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পরীক্ষার খাতায় লিখে কি কোনও লাভ হয়েছে কারুর? মনে হয় না।

খুব সম্প্রতি আমাদের দেশে এ মহাজন বাক্যটির অর্থ ও তাৎপর্য একদমই পাল্টে গেছে। পাল্টানো হয়েছে এটাও বলতে পারেন। অথচ যুগ যুগ ধরে এ মহাজন বাক্যের অসাধারণ গুরুত্ব দিয়েছি আমরা। বিশ্বাস করেছি। মর্যাদা দিয়েছি। কিন্তু এখন সেটা মিথ্যে বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ফালতু বলে হচ্ছে বিবেচিত।
দেখুন না, আজকাল দিব্যি হুকুম যাচ্ছে পাল্টে। পরিবর্তিত হচ্ছে অনায়াসে আইনও। আর হাকিম? প্রচলিত বিধানমতে হাকিম নড়তে পারে। শেষ হতে পারে হাকিমের মেয়াদও। বয়স হলে কী না হতে পারে। হাকিম হুকুম দেন। বিচার করেন। কলমের এক খোঁচায় হাকিম মানুষ মারতে মারেন। জেল দিতে পারেন মানুষকে। আবার ইচ্ছে করলে দয়াপরবশ হয়ে ফাঁসির আসামিকেও ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু হাকিম এজলাস ছেড়ে ভেগে যেতে পারেন তা আমাদের ধারনাতেই ছিল না। শুধু কী তাই? এখনতো হাকিমকে দেশছেড়ে পর্যন্ত ভাগতে হচ্ছে। কী হচ্ছে না?

আসলে রাষ্ট্রের যেক'টি অঙ্গ জরুরি তার মধ্যে বিচারব্যবস্থা অন্যতম। এর অবস্থান মজবুত হওয়া ব্যতীত কোনও রাষ্ট্র বা সরকার চলতে পারে না। আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা হলেও এর বিকল্প নেই। ঘুরেফিরে এর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই আমাদের। কিন্তু এস কে সিনহা বাবু তার কার্যকালে যা করেছেন তা বেনজির। কোনও দুর্ভাগ্যক্রমে ১৬ শ সংশোধনীতে হাত দিতে গিয়ে ফেঁসে গেলেন। অন্যথায় তাকে থামানোই যেন মুশকিল হয়ে পড়েছিল। কোথায় গিয়ে ঠেকাতেন, কে জানে?
বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন কেন? নিশ্চয় দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য। এ না হলে মানুষের সমাজ টিকে থাকবার কথা নয়। দুষ্টরা সবসময় প্রবল হয়। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সবকিছু নিজের দখলে রাখবার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে অশিষ্টজন। যেন পৃথিবীর সবই তাদের। এই জুলুম ঠেকাতে ও মজলুমকে রক্ষা করতেই বিচারের প্রবর্তন।
বিচারক পদটি মর্যাদাপূর্ণ এবং সম্মানের। বিচারের কাজটিও কঠিন এবং দায়িত্বপূর্ণ। একাজে সামান্য এদিক-ওদিক হলেই সর্বনাশ। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয় তাদের পক্ষে উকিল বা আইনজীবী কথা বলেন বিচারকের এজলাসে। যারা অভিযোগ করেন তাদেরও উকিল থাকেন। বাদী ও বিবাদীর পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবীর কথা শুনে বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে রায় বা আদেশ ঘোষণা করেন বিচারক। এতে অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত হলে সাজা হয়। জেল, জরিমানা, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে অভিযুক্তের। আবার নির্দোষ প্রমাণিত হলে খালাসও পান। এ হচ্ছে আইন ও বিচারকার্যের স্বাভাবিক গতি। তবে নানা কারণে কখনও কখনও এর ব্যতিক্রমও ঘটে যায়। অর্থাৎ সঠিক সাক্ষী-সাবুতের অভাবে প্রকৃত অপরাধী খালাস পায় এবং নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করেন। এটাই দুর্ভাগ্যজনক বা বিচারের ট্র্যাজেডি। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব বা চাপের কারণেও অনেক বিচারকার্য ব্যাহত হতে পারে। পাল্টেও যায় কখনও কখনও। এমন ঘটনা কেবল আমাদের মতো দেশেই নয়, পৃথিবীর আরও অনেক দেশে ঘটে।

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আমাদের দেশের প্রধান বিচারপতির আসনে বসবার সময় যতটা আলোচিত হন, তার চেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত হন বিদায়ের বেলা। বলা যায়, যারা তাকে এ পদে বসিয়েছিলেন তারাই আবার তাকে সেখান থেকে টেনেহেঁচড়ে নামিয়ে দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু কেন?
ওই যে কথায় বলে না, ‘যার শেষ ভালো তো সব ভালো।’ হ্যাঁ, সাবেক প্রধান বিচারপতির শেষটা আসলে ভালো কাটলো না। চরম অপমান আর লাঞ্ছনা নিয়ে বিদায় নিতে হলো মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই। কিন্তু তিনি নিজে যেমন এমনটা প্রত্যাশা করেননি, তেমনই তা দেশবাসীরও প্রত্যাশা ছিল না। বিদেশ যাবার সময় তিনি বলেছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু ভাগ্যের কী খেলা তা আর হলো না। এমনকি দুর্নীতি, অর্থপাচার, চারিত্রিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ থেকে চলে যেতে হলো। এরপর বিদেশে এজেন্সির লোক গিয়ে তার পদত্যাগ পত্রেও সই করিয়ে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আগেই এমন অভিযোগ করেছিলেন। ১২ নভেম্বরের জনসভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও একই অভিযোগ করেন।

আসলে দুষ্টুজনেরা আইন ও বিচার কার্যকর থাকুক চায় না। এটা থাকলে তাদের জোর খাটানোর সুবিধে। যাচ্ছেতাই করবার সুযোগ থাকে তাদের। আইন, বিচার, থানা, পুলিশ এসব না হলে তারা ফ্রিস্টাইল চলতে পারে। যা ইচ্ছে তাই নিজের কবজায় নেয়া তাদের জন্য সহজতর হয়। এটা যেমন দুষ্টুরা চায়, তেমনই একশ্রেণির ক্ষমতাধরও এমনটাই প্রত্যাশা করেন। এছাড়াও তাদের প্রত্যাশা আইন-আদালত তথা বিচারকার্যও যেন তাদের মর্জি মাফিক পরিচালিত হয়।
পৃথিবীর দুই-একটা দেশে পুলিশ বা এমন কোনও বাহিনী না থাকলেও আমাদের দেশে বা এশিয়ার কোনও দেশে তেমনটা ভাবাই যায় না। পুলিশ, র্যা ব, সোয়াত, আনসার, ভিডিপিসহ বেশ কয়েকটি বাহিনী থাকা সত্ত্বেও আমাদের জান-মালের নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি। এমনিতেই ঘর থেকে বেরুলেই খুন, অপহরণ, গুম হবার আশঙ্কা। এরপর পুলিশ বা অন্যসব সংস্থা না থাকলে পরিস্থিতি কতটা মারাত্মক হতে পারে তা আসলে আমাদের কল্পনারও অতীত।

যাই হোক, ‘হাকিম নড়েতো হুকুম নড়ে না’ এ প্রবাদ দিয়ে শুরু করেছিলাম আজকের পোস্টটি। কিন্তু এর সত্যতা আজকাল মেলে না। যেন সব বাসি হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম, হুকুমতো এখনকার দিনে নড়েচড়ে, বদলে যায়; পরিবর্তিত হতে পারে। এমনকি হুকুম পালটে দেবার জন্য হাকিমকে নানা নাটকিয়তার মাধ্যমে বিদেশে চালান করে দেবার ঘটনাও ঘটে গেলো সম্প্রতি আমাদের দেশে। কী, এসব কবিতার মতো কিছু বানিয়ে বানিয়ে বা কল্পনা করে বলছি? মোটেও না। যা ঘটেছে তাই বলছি। বলতে পারেন একথাগুলো ঘটনাপ্রবাহের খুব ক্ষুদ্র প্রতিধ্বনি মাত্র।
সব সম্ভবের এদেশে অনেক কিছু ঘটে। এর কিছু বলা যায়। কিছু বলা যায় না। বললে সমস্যা হতে পারে। তাই অনেক কিছু না-বলাই থেকে যায়। অবশ্য না-বলবার মধ্যেও অনেক কথা বলা হয়ে যায়। সোজাসুজি হয়তো বলা যায় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকই বলেন। লেখেনও কেউ কেউ। আর যারা বুঝবার তারা বোঝেনও। এমন করেইতো দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। এইতো আর কদ্দিন বাকি, কে জানে!

ক্ষমতাসীন ও মাসলম্যানরা আইন-আদালতকে দুর্বল এবং নিজেদের পক্ষে রাখতে চান। এতে তাদের সুবিধে। কিন্তু দেশের আইন, আদালত তথা বিচারব্যবস্থা দুর্বল হলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। অন্যদিকে ভিন্নমত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে সুবিধে পান ক্ষমতাসীনরা।
আদালতকে লাঠি দেখাতে এবং এর দরোজায় লাত্থি মারতেও দেখেছি আমরা। আর এসব করেছেন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তবে সাধারণ জনগণ আইন-আদালত বা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে এমন বিরূপ আচরণ করেন না। কোনও বিচার বা রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চতর আদালতে আপিল ও রিভিউ আবেদন করতে পারেন। কিন্তু মাস্তানি করতে পারেন না। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ আদালতের সঙ্গে মাস্তানি করেন, যা কেবল দুঃখজনকই নয়; অবমাননাকরও। সাধারণ কেউ এমন আচরণ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে সব রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না সহজে।
সম্প্রতি পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যেভাবে বিদায় নিলেন তা কারুর প্রত্যাশা ছিল না। তিনি নিজেও তা চাননি। তবে ক্ষমতাসীন দলটি চেয়েছে ঘোষণা দিয়েই। সংসদে এবং এর বাইরে প্রকাশ্যে হুমকি-ধামকি দেয়া হয়েছে। এটা আপাত ক্ষমতাসীনদের জন্য সুখকর হলেও খারাপ দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে দেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে।

প্রশাসনসহ রাষ্ট্র বা সরকারের প্রায় অঙ্গের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। বিচার বিভাগ ধোয়া তুলসীপাতা তা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু এ সত্ত্বেও এবিভাগটিই আমাদের আশাভরসার স্থল। এর মর্যাদা রক্ষা করতে হবে আমাদেরই। যারা এর বিরুদ্ধে অমর্যাদাকর কার্যক্রম চালাবে তাদের সম্পর্কে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। অন্যথায় আম ও ছালা উভয়ই হারাতে পারি আমরা। তাই যেকরেই হোক, আইন, আদালত ও বিচারব্যবস্থার ভাবমর্যাদা অক্ষুণœ রাখা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
এস কে সিনহা চলেই গেলেন। যদিও এ যাওয়া সবার কাক্সিক্ষত ছিল না। কিন্তু অনেকের জন্য এ যাওয়া ছিল খুবই কাক্সিক্ষত। সদ্যপদত্যাগী প্রধান বিচারপতি বিদেশ থেকে ফিরে পূর্বের আসনে বসতে পারলে পরিস্থিতি হয়তো উল্টে যেতে পারতো। তাই ক্ষমতাসীনদের ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলা যায় এ যাত্রা।

http://www.dailysangram.com/post/307976