১৭ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১৮

চোখ হারানোর আগে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন শাহজালাল!

ছিনতাইয়ের অভিযোগে যুবকের চোখ উত্পাটন ** খালিশপুর থানার সিসি ক্যামেরা নিয়ে ওসি ও ডেপুটি কমিশনারের পরস্পরবিরোধী তথ্য

পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর চোখ হারান খুলনার সেই হতভাগ্য সবজি ব্যবসায়ী মো. শাহজালাল-এটা তার স্বজনদের দাবি। চোখ হারানোর আগে তিনি পুলিশ হেফাজতেই ছিলেন-সম্প্রতি একটি সিসিটিভি ফুটেজেও এমন দৃশ্য দেখা গেছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে পুলিশের দাবি, ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে চোখ হারিয়েছেন শাহজালাল। অবশ্য ঘটনার পর থেকেই শাহজালালের দাবি ছিল, খালিশপুর থানার ফুটেজ পরীক্ষা করা হোক। খালিশপুর থানার দাবি, ফুটেজে শাহজালাল নেই। এদিকে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) দাবি, ঘটনার দিন সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট ছিল।

গত ১৮ জুলাই ছিনতাইয়ের অভিযোগে শাহজালালের দু’চোখ উপড়ে ফেলা হয়। তিনি এখন চোখ হারিয়ে অন্ধ। নগরীর খালিশপুর থানা এলাকার গোয়ালখালীতে ওই ঘটনা ঘটে। গত ২৬ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকে ‘শাহজালালের চোখ গেল কোথায়’ শীর্ষক লিড নিউজ প্রকাশিত হয়।

বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, নগরীর খালিশপুরের একটি ক্লিনিকের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পিবিআইয়ের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, পুলিশই শাহজালালকে প্রাথমিক চিকিত্সার জন্য ওই ক্লিনিকে নিয়ে যায়। তখনো শাহজালালের চোখ উপড়ে ফেলা হয়নি। চিকিত্সা শেষে পুলিশই শাহজালালকে নিয়ে বের হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রের মাধ্যমে এ তথ্য জানা গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে চাইছে না পিবিআই।

শাহজালাল ও তার স্বজনদের দাবি, ঘটনার দিন সাদা পোশাকে খালিশপুর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাসেলসহ দু’জন রাত ৮টার দিকে হঠাত্ শাহজালালকে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে আটক করে খুলনা-যশোর রোডের পাশে যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে বসেন। পরে পুলিশের গাড়ি এসে তাকে খালিশপুর থানা হাজতে নিয়ে যায়। পরে এএসআই রাসেল ও সোর্স রাসেল তার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে থানা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন ভোরে শাহজালালকে দুই চোখ হারানো অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাওয়া যায়।

পুলিশের দাবি, ঘটনার রাতে ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েন শাহজালাল। এ সময় গণপিটুনির পর তার দুটি চোখ তুলে নেয় জনতা। এ ব্যাপারে ওই রাতেই সুমা আক্তার নামে এক নারী বাদী হয়ে দুজনকে আসামি করে ছিনতাই মামলা দায়ের করেন। তবে এ মামলায় শুধু শাহজালালকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে।

ওসি ও ডিসির তথ্যে মিল নেই: অনুসন্ধানে জানা যায়, খালিশপুর থানার হাজত, প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ সিসিটিভি ক্যামেরায় আওতাধীন। শাহজালালের দাবি, তাকে সুস্থ অবস্থায় থানা হাজতে রাখা হয়েছিল অন্য আসামিদের সঙ্গে। যা সিসি ক্যামেরায় খোঁজ করলে পাওয়া যাবে।

সিসিটিভি ক্যামেরায় গত ১৮ জুলাই রাতের ফুটেজে শাহজালালকে দেখা গেছে কি না জানতে চাইলে খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিম খান বলেন, ‘আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত ১৮ জুলাই রাতের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছেন। এতে শাহজালালের কোনো ফুটেজ নেই।’

তবে এ ব্যাপারে কেএমপির ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, গত ১৮ জুলাই ঘটনার সময় সিসিটিভি ক্যামেরা খারাপ ছিল। ওই সময়ের কোনো ফুটেজ নেই। ফলে শাহজালাল থানায় গিয়েছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘যেহেতু মামলাটি বিচারাধীন, তাই আর কিছু বলা যাবে না।’

পিবিআই সূত্রে জানা যায়, খালিশপুর ক্লিনিকের সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে, শাহজালালকে নিয়ে আসা হয় প্রাথমিক চিকিত্সার জন্য। এ ব্যাপারে খালিশপুর ক্লিনিকের স্বত্বাধিকারী ডা. মুজাহিদুল ইসলাম জানান, তিনি কর্তব্যরত চিকিত্সকের কাছে শুনেছেন, ঘটনার রাতে পুলিশ একজন আসামিকে প্রাথমিক চিকিত্সা দেওয়ার জন্য ক্লিনিকে নিয়ে আসে। চিকিত্সার পর তাকে আবার পুলিশ নিয়ে যায়। তবে ওই সময় ওই রোগীর নাম এন্ট্রি করা হয়নি। তিনি আরো জানান, তদন্তকারী দল ক্লিনিকের সেই ফুটেজও নিয়ে গেছে। তবে সেই রোগী শাহজালাল ছিল কিনা তা তিনি জানেন না। এ ব্যাপারে পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কোনো কিছু বলা যাবে না। আদালতে আগামী ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’

অভিযুক্তদের বদলি না করায় হতাশা: এদিকে এ ঘটনায় শাহজালালের মা রেনু বেগম গত ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতে খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খানসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য খুলনা পিবিআইকে নির্দেশ দেন। গত ১৮ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। ওই দিন পিবিআই আরো সময়ের আবেদন করলে আগামী ২৬ ডিসেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়।

এ ব্যাপারে খুলনার মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, শাহজালালের বিরুদ্ধে দায়ের করা ছিনতাই মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। তিনি অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের থানার দায়িত্ব থেকে বদলি না করায় হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি দাবি করেন, খালিশপুর থানার ওসিকে বদলি না করলে মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত হবে না।

অন্যদিকে শাহজালালের বিরুদ্ধে দায়ের করা ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলার বাদী সুমা আক্তার গত ১৮ অক্টোবর খুলনা প্রেসকাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ওই ছিনতাইয়ের সঙ্গে শাহজালাল জড়িত।’

 

http://www.ittefaq.com.bd/capital/2017/11/16/136054.html