১৭ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৪

রাজনৈতিক রেষারেষিতে ময়লা যখন হাতিয়ার

লালবাগে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে ময়লা ফেলে সভা ভণ্ডুলের চেষ্টা -ছবি: নাসির উদ্দিন
ময়লার স্তূপ রেখে রাজনৈতিক সভা ভণ্ডুলের চেষ্টা হয়েছে রাজধানীতে। এর জের ধরে আওয়ামী লীগের দুইপক্ষে ব্যাপক সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে যানবাহনে। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল রাজধানীর লালবাগ এলাকায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুইপক্ষের বিবাদের জেরে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাজনৈতিক রেষারেষিতে যুক্ত হলো ময়লা তত্ত্ব।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের একপক্ষ বলছে, সভাস্থলের সামনে সিটি করপোরেশনের ময়লা ট্রাকে করে এনে ফেলে রাখা হয় যাতে সভাটি ভণ্ডুল হয়ে যায়। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। ময়লার স্তূপের বিষয়ে অন্য পক্ষের কাছ থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য মিলেনি। ঘটনায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও স্থানীয় দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সমর্থকরা পরস্পরকে দায়ী করছেন। দুই কাউন্সিলর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের অনুসারী বলে স্থানীয়দের দাবি। প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী জানান, সকালে রাজধানীর লালবাগ থানাধীন আজিমপুর রোডের পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি সভার আয়োজন করে। ১৮ই নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশ সফল ও নতুন সদস্য সংগ্রহের প্রস্তুতি নিতে এ সভা ডাকা হয়। সভার সভাপতি ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ এবং প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে আগত নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেন। তারা সেখানে এসে দেখেন, অনুষ্ঠানস্থলের প্রধান ফটকের সামনে ময়লার স্তূপ। এসময় কয়েকজন নেতাকর্মী ওই ময়লা কিছুটা সরিয়ে ফটকের সামনে সরু রাস্তা উন্মুক্ত করেন। এসময় উপস্থিত নেতাকর্মীরা এ ঘটনার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের পদত্যাগ দাবি করে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

এসময় অনুষ্ঠানস্থল থেকে কিছুটা দূরে পলাশীর মোড়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফির সমর্থিত প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী অবস্থান নেন। তারা মেয়র সাঈদ খোকনের সমর্থনে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। শাহে আলম মুরাদকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক থেকে পদত্যাগের দাবি জানান। এক পর্যায়ে শাহে আলম মুরাদের নেতাকর্মীরা মান্নাফির নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয়। এতে তারা সেখান থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তখন মান্নাফির নেতাকর্মীরা সংঘটিত হয়ে আবারো আজিমপুর রোডে আসলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পথচারীরা আতঙ্কে এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। সংঘর্ষের কারণে এলাকার দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সংঘর্ষের কারণে আজিমপুর রোড, ঢাকেশ্বরী রোড, এতিমখানার সামনে ও পলাশীর মোড়ে রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংঘর্ষ থামাতে এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে নেতাকর্মীদের সেখান থেকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সংঘর্ষ চলাকালে সেখানে প্রায় ৫টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। একটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এসময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনির গাড়িতেও ঢিল নিক্ষেপ করা হয়।
বেলা ১টার দিকে পরিস্থিতি পুলিশ নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষের খবর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পলাশীর মোড়ে অবস্থান নেন। তারা কারও পক্ষে কোনো স্লোগান না দিয়ে সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
শাহে আলম মুরাদের গ্রুপের নেতা লালবাগ যুবলীগের সহ-সভাপতি আশরাফুল ইসলাম জানান, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মুরাদ ভাই অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এটা ঢাকা মহানগর সিটি মেয়র এবং তার অনুসারী একই এলাকার সহ-সভাপতি মান্নাফি মেনে নিতে পারছেন না। তারা পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া লাগাতে চান। কিন্তু আমরা তাদের ফাঁদে পা দিতে চাই না। তিনি আরো জানান, পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে আমাদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল। আমরা পুলিশকে জানিয়েছিলাম। তবুও পরিকল্পিতভাবে অনুষ্ঠানস্থলের সামনে ময়লা ফেলা হয়েছে। এটা কোনো সভ্য মানুষের কর্মকাণ্ড হতে পারে না।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মান্নাফি সাংবাদিকদের জানান, তারা (মুরাদের সমর্থকরা) আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করেছে। আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই অপমান সহ্য করা যায় না। কারা সেখানে ময়লা ফেলেছে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গাড়ির অভাবে ময়লাগুলো সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা যায়নি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান দাবি করেন, কমিউনিটি সেন্টারে একটি সভা ছিল। কিন্তু, আমাদের কোনো দাওয়াত করা হয়নি। আমরা নিশ্চুপ ছিলাম। আমাদের নেতাকর্মীরা আজিমপুর ও পলাশীর মোড়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। ওই সময় শাহে আলম মুরাদের সমর্থকরা আমাদের দিকে তেড়ে আসে। তিনি এ ঘটনার জন্য শাহে আলম মুরাদকে দায়ী করেন। দীপু মনির গাড়িতে কারা ঢিল নিক্ষেপ করেছে জানতে চাইলে তিনি মুরাদ সমর্থকদের দায়ী করেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক নেতা ঘটনাস্থলে মানবজমিনকে জানান, গত ১লা নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শাহে আলম মুরাদের নেতাকর্মীরা সহ-সভাপতি মান্নাফিকে লাঞ্ছিত করেন। এসময় দুইপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এছাড়া মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার উদ্বোধনের দিন শাহে আলম মুরাদের নেতাকর্মীরা মান্নাফির নেতাকর্মীদের মঞ্চে উঠতে দেননি। সেখানেও দুইপক্ষের হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধের কারণে দুই গ্রুপের বিরোধ এখন তুঙ্গে। শীর্ষ নেতারা তাদের একাধিকবার নিয়ে বসতে চাইলে তারা কেউ কারও সঙ্গে বসতে রাজি হননি। গতকাল সংঘর্ষের মধ্যেই খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। সেখানে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে চলে যান। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, আগামীতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হলে দলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কোনো রকম দ্বন্দ্ব কাম্য নয়। আমাদের দ্বন্দ্বের কারণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতায় আসবে।

কেন এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলো বিষয়টি জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম গতকাল বিকালে মানবজমিনকে বলেন, সংঘর্ষের বিষয়ে আমি অবগত নই। এটা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিষয়। আমাকে দাওয়াত করার কারণে সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ মানবজমিনকে জানান, ১৮ই নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশ সফল করতে এই সভা ডাকা হয়। সিটি করপোরেশন পরিকল্পিতভাবে সেখানে ময়লা ফেলে রেখেছিল। এতে দলের নেতাকর্মীরা ক্ষিপ্ত হন। ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত। সংঘর্ষের ঘটনার জন্য তিনি ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার হাসিবুর রহমানকে দায়ী করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন মানবজমিনকে বলেন, আমরা সবাই শেখ হাসিনার অনুসারী। আমার ব্যক্তিগত কোনো অনুসারী নেই। আমি তো নগর পরিচালনা করি। আমার নাম তো সেখানে আসার কথা না।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের ডিসি ইব্রাহিম খান মানবজমিনকে জানান, কমিউনিটি সেন্টারে যে সভা হবে তা পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া ছিল। পুলিশ সেখানে আগেই থেকেই নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। তিনি আরো জানান, ওই সভাকে কেন্দ্র করে আজিমপুর রোডে অন্য একটি গ্রুপ পাল্টা সভা ডাকে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ তাদেরকে টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=92358