১৭ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩৬

খুনের ঘটনা বেড়েছে

চলতি বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার বলি ৪৪ জন

সারা দেশে খুনোখুনি চলছেই। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, মাদকের নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্ব, পারিবারিক সহিংসতা, যৌন লিপ্সা, যৌতুক প্রভৃতি কারণে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে শুধু রাজনৈতিক কারণে খুন হয়েছেন ৪৪ জন। পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণের পর হত্যাসহ নানা কারণে ৪৬৯ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়। এই সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন নারীকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে ১১ জন আত্মহত্যা করেছেন।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজধানীতে ২০১৪ সালের শুরু থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ১৫৯ জন খুন হেেয়ছেন। এই হিসাবে রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ১৯ জন খুন হন। সর্বশেষ মঙ্গলবার বনানীতে ব্যবসায়ী সিদ্দিক হোসাইন মুন্সিকে গুলি করে হত্যা করে চার দুর্বৃত্ত। চলতি মাসের শুরুতে পারিবারিক বিরোধের জেরে কাকরাইলে মা-ছেলেকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বাড্ডায় পরকীয়ার জেরে খুন করা হয় বাবা-মেয়েকে।
‘কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে’- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম যুগান্তরকে বলেন,

‘দেশে যেসব খুনের ঘটনা তা সাধারণভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এর একটি অর্থনৈতিক। অপরটি মানসিক। দেশে আইন আছে, প্রয়োগ নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করছে না। মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। এ কারণেই খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে।’ এর প্রতিকার কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সীমাবদ্ধতা থাকলে চলবে না। তাদের সচল করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘রাজনীতিতে যখন আদর্শের অভাব দেখা দেয়, লুটপাটের অর্থনীতি চলমান থাকে তখন সমাজে এর প্রভাব পড়ে। সমাজ থেকে পরিবার এবং সমাজের বিভিন্ন বলয়ে এর প্রতিফলন দেখা যায়।’ তিনি বলেন, ‘নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার যে মাত্রা দেখা যাচ্ছে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ।’
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নীতিহীন রাজনৈতিক চর্চা, অর্থনীতিকে সুশৃঙ্খল মানদণ্ডে নিয়ে আসা এবং গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।’এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, ‘কয়েক বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, খুনোখুনি একই পর্যায়ে রয়েছে। সামাজিক অস্থিরতাই খুনোখুনির অন্যতম কারণ।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘ঢাকায় যেসব খুনের ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশের রহস্যই আমরা উন্মোচন করেছি। জড়িতদের আইনের আওতায় এনেছি। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করার ক্ষেত্রে আমরা সচেতনতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছি। লোকাল কমিউনিটিকে এর সঙ্গে যুক্ত করে এসব ঘটনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
যেসব কারণে খুনোখুনি : ডিএমপির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে রাজধানীতে ১৬৬ জন খুন হয়েছেন। ২০১৬ সালে রাজধানীতে খুন হন ১৬৭ জন, ২০১৫ সালে ২৩৯ জন, ২০১৪ সালে ২৬২ ও ২০১৩ সালে ২৭০ জন। গত ৮ বছরে রাজধানীতে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে খুন হয়েছেন ২৯ জন নেতাকর্মী। এসব খুনের পেছনের কারণগুলো হচ্ছে- আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসা, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ক্যাবল ব্যবসা ও দখলবাজি। এর বাইরে পারিবারিক বিরোধ ও পরকীয়ার কারণেও একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিশোরদের গ্যাং কালচারের কারণেও একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বনানীতে নিজ অফিসে খুন হন ব্যবসায়ী সিদ্দিক হোসাইন মুন্সি। পুলিশের ধারণা, ব্যবসায়িক কারণে প্রতিপক্ষ তাকে খুন করেছে। পরিবারের ধারণা চাঁদা না দেয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। সোমবার ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে খুন হন ফার্নিচার ব্যবসায়ী কামাল হোসেন। ১১ নভেম্বর বগুড়ায় চাঁদা ও ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্বে খুন হন স্থানীয় যুবলীগ কর্মী আবু সাঈদ। ১ নভেম্বর রাতে রাজধানীর বাড্ডায় পরকীয়ার জেরে নৃশংসভাবে খুন হন জামিল শেখ ও তার ৯ বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার জিদনী। এ খুনের সঙ্গে জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনা ও তার প্রেমিক শাহীন জড়িত। এ ঘটনার একদিন আগে ৩১ অক্টোবর পারিবারিক বিরোধের জেরে খুন হন শামসুন্নাহার করিম ও তার ছেলে শাওন করিম। ১০ আগস্ট বরগুনার পাথরঘাটা কলেজের পেছনের খাসপুকুর থেকে হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে পাথরঘাটা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আনান দানিয়ালসহ ছাত্রলীগের চার নেতা। চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর আদাবরে খুন হন ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতা মশিউর রহমান মশু। স্থানীয় আধিপত্য, অবৈধ আয়ের ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটে। ৯ আগস্ট মোহাম্মদপুরে খুন হন স্থানীয় যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিন।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/17/172294