১৭ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৬

বছরে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা গচ্চা

ডিজেলভিত্তিক ৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন

তরল গ্যাস আমদানির সিদ্ধান্তের পরও সরকার উচ্চমূল্যে ডিজেলভিত্তিক চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। চারটি কেন্দ্র থেকে আটশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে বছরে সরকারের গচ্চা যাবে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। ডিজেলের পাশাপাশি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৬টি কেন্দ্রেরও অনুমোদন দিয়েছে সরকার। আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমের চাহিদার অজুহাত দেখিয়ে অনুমোদন দেয়া বেসরকারি খাতের এ ১০টি কেন্দ্র থেকে এক হাজার ৭৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ডিজেলভিত্তিক চারটি কেন্দ্র থেকে ৮শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ বিদ্যুৎ সরকার কিনে নেবে। পাঁচ বছর পর্যন্ত চারটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেনার জন্য সরকারের ব্যয় হবে ৫৫ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছরে ব্যয় হবে ১১ হাজার ১৬২ কোটি ৮০ লাখ টাকা (প্রতি ইউনিটের দাম ২০ টাকা ধরে)। অথচ আমদানিকৃত তরল গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনলে সরকারের ব্যয় হতো এক হাজার ৬৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা (প্রতি ইউনিট ৩ টাকা)। গ্যাসের দাম না বাড়ানো পর্যন্ত আমদানিকৃত তরল গ্যাসে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম একই থাকবে। রহস্যজনক কারণে সরকার তরল গ্যাসের পরিবর্তে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে। এ চারটি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারের বছরে ৯ হাজার ৪৮৮কোটি ৩৮ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হবে। এদিকে আগামী গ্রীষ্মের আগে ৫০০ এমএমসিএফ লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস
(এলএনজি) আমদানি করবে সরকার। এখন থেকে ১৫০ এমএমসিএফ গ্যাস পিডিবিকে দেয়া হলে বিদ্যমান সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব বলে জানা গেছে। সরকার এদিকে না গিয়ে উচ্চমূল্যের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। এ দফায় অনুমোদন পাওয়া ১০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮টির কার্যাদেশও দেয়া হয়েছে। শিগগির বাকি দুটি কেন্দ্রের কার্যাদেশ দেয়া হবে বলে জানা গেছে।

পিডিবির চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ এর আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিদ্যমান গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ১৫০ এমএমসিএফ অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করা হলে খুব সহজেই আরও ৬০০-৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
জ্বালানি বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, তারা আগামী এপ্রিলে ৫০০ এমএমসিএফ এলএনজি আমদানি করবে। পিডিবির চেয়ারম্যানের প্রত্যাশা ১৫০ এমএমসিএফ অতিরিক্ত গ্যাস। আমদানিকৃত গ্যাস তার প্রত্যাশার চেয়ে ৩৫০ এমএমসিএফ বেশি। তারপরও বিদ্যমান গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন না বাড়িয়ে দ্রুত ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদনের বিষয়টি রহস্যজনক।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ১৭৬৮ মেগাওয়াটের এই ১০ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা গুনতে হবে। এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেনার মেয়াদ ৫-১৫ বছর। চুক্তির পুরো মেয়াদে এ পরিমাণ টাকা (১ লাখ ৪০ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা) ব্যয় হবে। এর মধ্যে শুধু ডিজেলভিত্তিক চারটি প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য ৫ বছরে ৫৫ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিদিন ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। আর বাকি ৬টি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খরচ হবে ৮৪,৭১৮ কোটি টাকা। এসব কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ৯৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হবে ১৫ বছরের জন্য।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে যদি তেলের দাম বৃদ্ধি পায় তবে সরকারকেও বাড়তি টাকা গুনতে হবে। তবে তেলের দাম কমলে বিদ্যুতের দাম কমবে না। পিডিবি সূত্র জানায়, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য সরকারকে প্রতি ইউনিটে ১৮-২০ টাকার বেশি অর্থ গুনতে হবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ঘুষ লেনদেন আর লুটপাটের কারণে বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আদর্শিকভাবে এ খাতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। এ ছাড়া বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় ভোক্তারা বছরে ৭ হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, পরিকল্পিতভাবে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয়নি। বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। দুর্নীতিবাজরা আছে পর্দার অন্তরালে। একেকটি পাওয়ার প্ল্যান্ট করতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে, তার অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো করা সম্ভব ছিল। কিন্তু টনে টনে ঘুষ লেনদেন করতে গিয়ে এটা করা হয়নি।
পিডিবির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যথাসময়ে উৎপাদনে আসছে না। কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে না এনে সরকার একের পর এক উচ্চমূল্যের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে। অভিযোগ আছে পিডিবি ও মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের যোগসাজশে এসব কাজ চলছে। বিদ্যুৎ বিভাগ ঘিরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেট পুরো সেক্টরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সম্প্রতি কার্যাদেশ দেয়া ৮টি উচ্চমূল্যের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদনের পেছনেও এই সিন্ডিকেটের হাত আছে বলে অভিযোগ করেন পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, উচ্চমূল্যে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের হার মানতে হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে পাঠানো প্রস্তাব সূত্রে জানা গেছে, বাংলা ট্র্যাক লিমিটেড যশোরে ১০০ মেগাওয়াটের ডিজেলভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। ওই কেন্দ্র থেকে পিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় করবে প্রতি ইউনিট ২৫.৪১৭ মার্কিন সেন্টে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ইউনিটের মূল্য পড়বে ২০ টাকা। চুক্তির ৫ বছরের মধ্যে সরকারকে ওই কেন্দ্রের জন্য গুনতে হবে ৭ হাজার ৫ কোটি টাকা।
একই কোম্পানি কুমিল্লায় ২০০ মেগাওয়াটের আরেকটি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। এ কেন্দ্র থেকেও একই দামে সরকার বিদ্যুৎ কিনবে। এতে ৫ বছরের মধ্যে সরকারকে গুনতে হবে ১৪ হাজার ১১ কোটি টাকা। বাংলা ট্র্যাক লিমিটেডের এই কেন্দ্র দুটি থেকে সরকার পাঁচ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ২১ হাজার ১৬ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনবে।

এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে ২০০ মেগাওয়াটের একটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। প্রস্তাব অনুযায়ী এ কেন্দ্র থেকে সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয় করবে ২৫.০০৩৯ মার্কিন সেন্টে। ৫ বছরে সরকারকে এ কেন্দ্র থেকে ১৩ হাজার ৭৮২ কোটি টাকার বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হবে।
এপিআর এনার্জি কেরানীগঞ্জে ডিজেলভিত্তিক ৩০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। এ কেন্দ্র থেকে সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে ২৫.৪১ মার্কিন সেন্টে। ৫ বছরে এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে গুনতে হবে ২১ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
অপরদিকে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব অনুযায়ী, সামিট গ্রুপ কড্ডাতে ৩০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। এ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ে খরচ হবে ১০.৬০ মার্কিন সেন্ট। ১৫ বছর মেয়াদি এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য সরকারকে গুনতে হবে ২৬ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা।

কনফিডেন্স পাওয়ার বগুড়ায় একটি ১১৩ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। এ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারের খরচ হবে ১০.৬০ সেন্ট। মেয়াদকালীন সময়ে এ কেন্দ্রের জন্য সরকারের গুনতে হবে ৯ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
মিডল্যান্ড পাওয়ার কোম্পানি আশুগঞ্জে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। এ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হবে ১০.৫০ মার্কিন সেন্ট। এখানে চুক্তিকালীন সময়ে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে গুনতে হবে ১৩ হাজার ২৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাব অনুযায়ী খুলনায় ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে ওরিয়ন গ্রুপ। এখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ১০.৬০ মার্কিন সেন্ট। এ কেন্দ্রের জন্যও সরকারকে গুনতে হবে ৯ হাজার ২০৩ কোটি টাকা।
অ্যাক্রোন জুলদায় একটি ১০০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। যার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে খরচ পড়বে ১০.৫০ মার্কিন সেন্ট। এ কেন্দ্রের জন্য সরকারকে গুনতে হবে ৮ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
দেশ এনার্জি চাঁদপুরে একটি ২০০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। তারা ১০.৬৫ মার্কিন সেন্টে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রয় করবে। এতে চুক্তির মেয়াদে সরকারকে গুনতে হবে ১৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/17/172285