১৭ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:১৮

আট মাসে নেমেছে ৯১ হাজার নতুন যান

উড়াল সড়কের টাকায় সার্বিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব; আগামী ৭ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা হবে দ্বিগুণ

উড়াল সড়ক তৈরির আসক্তি থেকে এখনই মুখ না ফেরালে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে দেশের নগর সভ্যতায়। এমনই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে যানজট সৃষ্টির মূল কারণের দিকে ফোকাস না করে বিপুল অঙ্কের অর্থের এ বিনিয়োগ অনর্থক হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এমন সময় আসতে পারে তখন আরো বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হবে দৈত্যাকৃতির উড়াল সড়কগুলো সরাতে। উন্নত দেশগুলোর কয়েকটি শহরে এ নজির ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে শহরজুড়ে শুধু উড়াল সড়ক তৈরি না করে যেসব কারণে যানজট দিন দিন লাগামহীন হয়ে পড়ছে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের মতে ঢাকা শহর যাতে অকার্যকর না হয়ে পড়ে সেজন্য এ শহরের নাগরিক কেন্দ্রগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঢাকা শহরমুখী স্রোত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানুষ যাতে এ শহরে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে অর্থাৎ তার দোরগোড়াতেই যাতে সব সেবা উপস্থিত থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেজন্য উড়াল সড়কের পেছনে লাখো কোটি টাকা ব্যয় না করে সেই টাকা দিয়ে শহরের বাইরে কর্মক্ষেত্র ও সেবাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। ফলে নাগরিক সংখ্যা কমে গেলে যানজটও কমে যাবে।

সার্বিক বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি নগরীর ক্ষুদ্র যান সংখ্যা কমিয়ে এনে উন্নতমানের বাস ও সারফেস রেল নির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। গত বছর ঢাকায় নতুন যানবাহনের নিবন্ধন হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৫২০টি। আর চলতি বছর প্রথম আট মাসে এই সংখ্যা ছিল ৯১ হাজার ৩৫০টি। যানবাহন বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে গোটা শহর উড়াল সড়কে ভরিয়ে ফেললেও যানজট সমাধান হবে না। এ ছাড়া বর্তমান সঙ্কট সামাল দিতে রাস্তার ওপর পার্কিং বন্ধ ও বিদ্যমান রাস্তার পূর্ণ ব্যবহারসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. মাহবুব উননবী নয়া দিগন্তকে বলেন, চার দিক থেকে সব মানুষকে ঢাকায় আনার আয়োজন করা হচ্ছে সর্বোতভাবে। ঢাকা আসতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের প্রয়োজন পূরণে। কিন্তু মানুষের যেন ঢাকায় আসার প্রয়োজন না হয় সে পরিকল্পনা করা হচ্ছে না। তা ছাড়া এত মানুষ ঢাকা আসার পর এখানে তারা কিভাবে চলবে সে ব্যবস্থাও নেই। সে কারণে দেখা যায় শহরের বাইরে থেকে অতি দ্রুত এসে ঢাকার প্রবেশ মুখে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। ঢাকায় প্রবেশের সাথে সাথে আর গাড়ি চলতে চায় না।
প্রফেসর নবী বলেন, যানজট থেকে মুক্তি পেতে হলে সবার আগে ঠিক করতে হবে ঢাকা কোথায় কত দূর গিয়ে থামবে এবং এর মধ্যে কত লোক বাস করবে। সে আলোকে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। তিনি বলেন, লন্ডন, টোকিও, নিউ ইয়র্কের জনসংখ্যা গত ৩৫ বছরে বাড়েনি। ফলে এসব শহরে যেসব পরিবহন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা টেকসই হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সব মানুষ ঢাকার দিকে ছুটে আসছে। এ স্রোত থামাতে না পারলে কোনো উদ্যোগ কাজে আসবে না। ঢাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদি যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে ২০২৪ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা ধরা হয়েছে তিন কোটি ৬০ লাখ। কিন্তু এরপর জনসংখ্যা যখন পাঁচ কোটি হবে তখন এ পরিকল্পনা অকার্যকর হয়ে যাবে। বিকেন্দ্রীকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, যে কারণে মানুষ ঢাকায় আসে সেসব কারণ গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। মানুষ ঢাকা আসে সাধারণত কর্মসংস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং উন্নত জীবনযাপনের জন্য। এগুলো যদি বিভাগ, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে মানুষের এভাবে ঢাকা ছুটে আসার প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেন আশুলিয়ার মানুষকে সহজে ঢাকায় আনার জন্য ঢাকা আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হচ্ছে। কিন্তু আশুলিয়ার মানুষকে যাতে ঢাকা আসতে না হয় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে না সেখানে।

বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বর্তমান প্রফেসর ড. সারওয়ার জাহান ও সাবেক প্রফেসর খ ম মনিরুজ্জামান একই মত পোষণ করে বলেন, বৈষম্যহীনভাবে আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে এবং ক্ষমতা ও উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে যানজট থেকে মুক্তি পেতে হলে। অন্যথায় ঢাকা মহানগরীকে বসবাসের শহর হিসেবে রক্ষা করা যাবে না। প্রফেসর সারওয়ার জাহান বলেন, যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। একই সাথে বাস র্যা পিড ট্রানজিট বা বিআরটি নির্ভর সহজ গণপরিবহন ব্যবস্থা গ্রহণ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করতে হবে স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে।
নগরীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়কের বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পরিবহন প্রকৌশলী ড. মাহবুবুল বারী বলেন, যতই রাস্তা বানাবেন ততই গাড়ি নামবে। চাহিদা না কমালে যোগান দিয়ে কখনোই কুলানো যাবে না। সুতরাং উড়াল সড়ক বানালেই যানজট কমবে এটি একটি ভুল ধারণা বরং গাড়ি বিশেষ করে প্রাইভেট কার এবং অন্যান্য ুদ্রযান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে পৌনে দুই কোটি মানুষ। এত বিপুল পরিমাণ মানুষের পরিবহন সমস্যা শুধু গাড়ি দিয়ে সমাধান করা যাবে না। সবাইকে গাড়িতে ওঠাতে চাইলে কোনো গাড়িই চলতে পারবে না। আর শহরে চাইলেই রাস্তা বাড়ানো যায় না। সে জন্য হাঁটা, সাইকেল এবং পাবলিক পরিবহননির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত। এতে বাঁচবে নগরীর পরিবেশ।
দেবরা ইফরইমসন এবং ড. বারির একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জাকার্তায় এক হাজার ৮০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ব্যয় করা হয়েছে রাস্তা উন্নয়নের জন্য। শহরের মধ্যে তারা ছয়টি লেনযুক্ত হাইওয়ে এবং কিছু বাইপাস নির্মাণ করেছে। ফলে শহরে ২.৫ ভাগ রাস্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এ সময়ে গাড়ি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি বছর শতকরা ১০ ভাগ হারে। ফলে শেষ পর্যন্ত এ কর্মসূচির সাথে জড়িত কনসালট্যান্টরা স্বীকার করেছেন যে, যতই নতুন রাস্তা তৈরি করা হোক না কেন, রাস্তার চাহিদা কখনো পূরণ করা সম্ভব নয়।
দিনে নামছে ৩০২ গাড়ি : বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সর্বশেষ গত আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় চলতি বছর প্রতিদিন নেমেছে ৩০২টি গাড়ি। এর মধ্যে প্রাইভেট কার ৬৪টি।
রাজধানীতে বর্তমানে মোট নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার ৭০৮টি।
এর মধ্যে বাস ৩০ হাজার ২৭৪টি, মিনিবাস ১০ হাজার ৩২৬, মাইক্রোবাস ৭১ হাজার ৭০০, মোটরসাইকেল চার লাখ ৮৩ হাজার ৮১৯ আর প্রাইভেট কার দুই লাখ ৫৫ হাজার ৬২২টি।

২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোটরযান নিবন্ধন দেয়া হয়েছে ৯১ হাজার ৩৫০টি। এর মধ্যে প্রাইভেট কার ১৪ হাজার ৩৭৩টি।
২০১৬ সালে ঢাকায় মোট মোটরযান নিবন্ধন হয় এক লাখ ১০ হাজার ৫২০টি। এর মধ্যে প্রাইভেট কার ১৮ হাজার ১০টি।
সিঙ্গাপুরে রয়েছে অত্যন্ত উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা। দেশটি আগামী বছর থেকে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের লাইসেন্স প্রদান সম্পূর্ণ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে যানজট ও পরিবেশ দূষণ রোধে। এর পরিবর্তে তারা বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে গণপরিবহন ব্যবস্থাকে আরো বিস্তৃত করতে।
ড. মাহবুবুল বারী বলেন, ঢাকা শহরে ৭৬ শতাংশ ট্রিপ হয় পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে আর ৫০ শতাংশ ট্রিপ হয় দুই কিলোমিটারের মধ্যে। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতকারীদের হাঁটার ব্যবস্থা করতে পারলে যানজট সমস্যার অনেক সমাধান হয়ে যাবে। সে জন্য হাঁটার উন্নত পরিবেশ তৈরি করা দরকার।
ড. বারীর মতে, একটি প্রাইভেট কার গড়ে ২ দশমিক ২ জন যাত্রী বহন করে দিনে। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ঢাকার ৬০ ভাগ রাস্তা প্রাইভেট কারের দখলে ছিল এবং তখন প্রাইভেট কারে যাত্রী পরিবহনের পরিমাণ ছিল শতকরা ১৭ ভাগ। ২০০৮ সালে এসটিপি স্টাডিতে বলা হয়েছে, ঢাকায় ১৮ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট কার ও ুদ্র মোটরযান ব্যবহার করে। পাবলিক বাস ব্যবহার করে ৩৪ ভাগ যাত্রী। অনেকের মতে ঢাকার মূল সড়কের ৭০ ভাগের বেশি বর্তমানে প্রাইভেট কারের দখলে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা এক কোটি ৫৯ লাখ এবং ২০৩৫ সালে দুই কোটি ৬০ লাখ। ঢাকার জনসংখ্যা, যানবাহন বৃদ্ধির হার হিসেবে করে এ সমীক্ষায় আশঙ্কা করে বলা ২০৩৫ সালে যানবাহনের গতি কমে দাঁড়াবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার।

জাতিসঙ্ঘ প্রণীত মেগাসিটির তালিকা অনুযায়ী এক কোটির ওপরে বসবাসকারী নগরীকে মেগাসিটি বলা হয়। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর যেসব শহরে দ্রুত মানুষ বাড়ছে ঢাকার অবস্থান তার মধ্যে সবার ওপরে। ১৯৭৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্রুতগতিতে মানুষ বাড়ছে বিশ্বের এ রকম ১০টি শহরের তালিকায় তালিকার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা মেগাসিটি। ১৯৭৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ঢাকায় গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জাতিসঙ্ঘের হিসাবে ২০০৭ সালে ঢাকা মেগাসিটির জনসংখ্যা ছিল এক কোটি ৩৫ লাখ। ২০১৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে এক কোটি ৭০ লাখ এবং ২০২৫ সালে এটি বেড়ে দাঁড়াবে দুই কোটি ২৫ লাখে।

তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ সবকিছুকে ছাপিয়ে ঢাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা এসটিপিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সাল নাগাদ বৃহত্তর ঢাকার জনসংখ্যা ধরা হয়েছে তিন কোটি ৬০ লাখ।
প্রফেসর মাহবুব উননবী বলেন, বিশ্বের কোনো শহরে এত দ্রুত মানুষ বাড়ার রেকর্ড নেই। ঢাকায় মানুষ ডেকে আনার একমুখী এ উন্নয়ননীতি পরিত্যাগ করে বিকেন্দ্রীকরণ করতে না পারলে যানজটের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/269036