১৬ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৫১

বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটারে ভোগান্তি

রাজধানী উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টর, ১০ নম্বর রোডের ১৮ নম্বর বাড়ি। এ বাড়িসহ উত্তরা ৩, ৯, ১২ নম্বর সেক্টরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গত কয়েক মাসে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ‘বিনামূল্যে’ সংযোজন করে দিয়েছে বিদ্যুতের প্রি পেইড মিটার। যেটিকে ডেসকো কর্তৃপক্ষ বলছে ‘স্মার্ট কার্ড বেস’ প্রি পেইড মিটার। কর্তৃপক্ষের দাবি, এ মিটার ব্যবহারের ফলে গ্রাহক বাঁচবেন ভুতুড়ে বিল থেকে। অন্যদিকে, ডেসকো বেরিয়ে আসতে পারবে ‘সিস্টেম লস’ থেকে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রি পেইড মিটারের গ্রাহকরা রিচার্জ কার্ড ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজন মতো বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন।
আবার বিতরণ কোম্পানিগুলোও বিদ্যুৎ সরবরাহের আগেই পেয়ে যাবে বিল। যা এখন পায় প্রায় দুই মাস পর। এভাবে বিদ্যুতের গ্রাহক ও বিতরণ কোম্পানি দু’পক্ষই লাভবান হবেন। তবে সরজমিন অনুসন্ধানে মিলেছে এ নিয়ে গ্রাহক অসন্তোষের নানা কাহিনী।

প্রি পেইড মিটার ব্যবহার করতে গিয়ে দু’মাসেই রীতিমতো বিরক্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত রাজু নুরুল। তিনি মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে জানান, প্রি পেইড মিটারে কোনো গ্রাহক তার জন্য অনুমোদিত পরিমাণের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারেন না। রিচার্জ করার অর্থের বিপরীতে যতটুকু বিদ্যুৎ গ্রাহক পাওনা হন- তা ব্যবহার শেষ হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে এরই মধ্যে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে রাজু বলেন, এক মাস আগের ঘটনা। মধ্যরাত। আমার বৃদ্ধ বাবা তখন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। হঠাৎ বাসার বিদ্যুৎ চলে যায়। লক্ষ্য করে দেখি, অন্যান্য বাসায় বিদ্যুৎ আছে। নিচে মিটার রুমে গিয়ে দেখি রিচার্জের টাকা শেষ। তিনি বলেন, আমরা কর্মজীবী মানুষ। আমাদের পক্ষে এটা মনে রাখা খুবই মুশকিল যে, কবে আগের মাসের বিল দিয়েছি। ব্যালেন্স কত আছে। কবে পরের বিল দিতে হবে, ইত্যাদি।

সবশেষ মাসের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, সকালে অফিস যাওয়ার পথে দেখলাম, আমাদের মিটারে লাল বাতি দেখাচ্ছে। ফলে অফিস যাওয়ার পথে রিচার্জ করতে গেলাম। বাসা থেকে ৪০ টাকার রিকশা ভাড়ার পথ। যাওয়া-আসা ৮০ টাকা। রিচার্জ সেন্টারে গিয়ে দেখি, সাত সকালেই লম্বা লাইন। ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে ২০০০ টাকা রিচার্জ করলাম। একাউন্টে জমা হয় মাত্র ১৬৮৪ টাকা! রিচার্জের সঙ্গে সঙ্গেই ৩১৬ টাকা হাওয়া। রিসিট লক্ষ্য করে দেখি, সার্ভিস চার্জ ২০ টাকা। কিসের সার্ভিস চার্জ? যারা রিচার্জ সেন্টারে কাজ করছে তাদের? অফিস ভাড়া? কর্মচারীদের বেতন? সেটা কি সরকার দিচ্ছে না? তিনি বলেন, প্রি পেইড মিটারে তো আগের মতো বাড়ি বাড়ি মিটার রিড করার ব্যাপার নেই। তাহলে সার্ভিসটা কিসের? ডিমান্ড চার্জ ১২০ টাকা। কিসের ডিমান্ড? কার ডিমান্ড? কে ডিমান্ড করেছে? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, রিচার্জ সেন্টারের কেউ এর জবাব দিতে পারেনি।
রাজু নুরুল বলেন, আমাকে জোর করে একটা মিটার ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি তো এই প্রি পেইড মিটার চাইনি? অথচ মিটার লাগিয়ে এখন আবার সেই মিটারের দাম বাবদ টাকা কাটা হচ্ছে। অথচ আমি বাসার ভাড়াটিয়া। যদি মিটারের দাম কাউকে দিতে হয়, তাহলে সেটা বাড়িওয়ালা দেবে নয়তো সরকার। আমি কি বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময় মিটার খুলে নিয়ে যাবো?
প্রবীণ সাংবাদিক রফিকুজ্জামান বলেন, প্রি পেইড মিটারে একজন গ্রাহক একমাসে যতবার রিচার্জ করেন তার কাছ থেকে ততবারই ৪০ টাকা করে মিটার ভাড়া নেয়া হয়। এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। তিনি বলেন, প্রি পেইড মিটার লাগানোর সময় আমাদের পুরনো মিটারগুলো ডেসকোর লোকজন খুলে নিয়ে গেছে। ওই মিটারের পরিবর্তে আমাদের কোনো টাকা দেয়া হয়নি। তাহলে আমরা তো ধরে নিতে পারি, ডেসকো কেবল মিটার প্রতিস্থাপিত করেছে। তাহলে নতুন করে কেন আমাদের মিটার ভাড়া দিতে হবে?
প্রি পেইড মিটারের আরেক গ্রাহক বসিলার রোকনুজ্জামান বলেন, প্রি পেইড মিটার ব্যবহারে আমার বিদ্যুৎ বিল বেশি আসছে। অক্টোবর মাসে যেখানে আমার বিদ্যুৎ বিল ৭৪২ টাকা এসেছিল, চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে খরচ হয়ে গেছে এর চাইতে বেশি অর্থ। তিনি বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় প্রি পেইডের রিচার্জ সেন্টার কম। প্রি পেইড মিটারে কার্ড রিচার্জ করতে হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংকের শাখা থেকে। ফলে নির্দিষ্ট শাখায় গিয়ে গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন দিতে হচ্ছে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে ‘কনসাস কনজুমার সোসাইটি’র পলাশ মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, প্রি পেইড স্মার্ট মিটারের নামে গ্রাহকদের পকেট কাটার বেশকিছু তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। মিটার ভেদে চার্জ কাটার বৈষম্য ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি, আমরা আগামী সপ্তাহেই আদালতে একটি রিট দায়ের করতে সক্ষম হবো।
জানা গেছে, এরই মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৫ লাখেরও বেশি গ্রাহককে প্রি পেইড মিটার দেয়া হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এই সংখ্যা ৬৩ লাখে উন্নীত হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব বিদ্যুৎ গ্রাহককে এই পরিষেবায় যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী জুন মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১০ লাখ ৬০ হাজার, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৩১ লাখ, ডিপিডিসি ১০ লাখ, ডেসকো ৫ লাখ, পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ৫ লাখ, উত্তরাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (নওজোপাডিকো) ৬ লাখ প্রি পেইড মিটার লাগাবে। এরই মধ্যে যে ৫ লাখের বেশি মিটার লাগানো হয়েছে এগুলো তার বাইরে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=92177