১৬ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৫০

ঠাকুরগাঁও টু কাওরান বাজার, ১৯ ঘাটে গুনতে হয় টাকা

মঙ্গলবার বিকাল ৩টা। ঠাকুরগাঁও জেলার নারগুন বাজার থেকে সবজি নিয়ে একটি ট্রাক নং-ঢাকা-মেট্রো-ট-১৩-৪৬৬৫ কাওরান বাজারের উদ্দেশে রওনা দেয়। দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে কাওরান বাজার আসা পর্যন্ত ১৯টি স্থানে ট্রাকচালক রতনকে দিতে হয় চাঁদা ও সরকার নির্ধারিত টোল। এছাড়া অনির্ধারিত স্থানে হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশকেও দিতে হয়েছে টাকা। রতন জানিয়েছেন, তিনি নিয়মিত এ রুটে পণ্য পরিবহন করেন। প্রতি ট্রিপে গড়ে এক হাজার আটশ’ টাকা থেকে ২৫ শ’ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পণ্য পরিবহনে ট্রাক থেকে চাঁদা আদায়ের কারণে ভাড়া অনেক বেড়ে যায়। এই বাড়তি ভাড়ায় পণ্যের দামও বেড়ে যায়। চালক রতন চাঁদা দেয়ার রসিদ দেখিয়ে মানবজমিনকে পুরো পথে চাঁদা আদায়ের বর্ণনা দেন। বলেন, ট্রাকটি ঠাকুরগাঁও পার হওয়ার আগে সেখানকার শ্রমিক কল্যাণ সংগঠনের নামে তার কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হয় ৫০ টাকা। ঠাকুরগাঁও থেকে বের হয়ে দশমাইল। সেখানেও শ্রমিক কল্যাণ সংগঠনের নামে আবারো তাকে দিতে হয় ৫০ টাকা। দিনাজপুর আসার পর স্থানীয় পৌরসভার অনুমোদিত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ভ্যান, ট্রলি ও ট্যাংকলরি টোল আদায় কর্তৃপক্ষ ৫০ টাকা চাঁদা নেয়। একই স্থানে আবার দিনাজপুর জেলা ট্রাক ও ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের মৃত শ্রমিক সদস্যের পরিবারবর্গ ও পঙ্গু সদস্যদের কল্যাণার্থে সাহায্যের চাঁদা দিতে হয় ৫০ টাকা। ট্রাকটি সিরাজগঞ্জ পৌঁছালে সিরাজগঞ্জ জেলা ট্রাক ও ট্যাংকলরি মালিক গ্রুপ ও শ্রমিক সংগঠন যৌথ সার্ভিস চার্জ আদায় করে আরো ৫০ টাকা এবং সিরাজগঞ্জ গোলচত্বরে ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয় ১০০ টাকা। তারপর ট্রাকটি ঘোড়াহাট গেলে পৌরসভা শ্রমিক ইউনিয়ন নেয় ৩০ টাকা। সেখান থেকে গোবিন্দগঞ্জ আসলে সেখানকার শ্রমিক ইউনিয়নের নামে নেয়া হয় আরো ৫০ টাকা। এরপর ট্রাকটি বগুড়া পৌঁছালে সেখানে পাঁচ স্থানে আদায় করা হয় চাঁদা। বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতি নেয় ৪০ টাকা। বগুড়া জেলা পরিষদ ও বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির পরিচালনায় বগুড়া কেন্দ্রীয় ট্রাক টার্মিনালে ২০ টাকা, বগুড়া আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন পঙ্গু, মৃতকালীন, কন্যাদায়, শিক্ষাবৃত্তি ও চিকিৎসার সাহায্যার্থে আদায় করে ২০ টাকা। উত্তরবঙ্গ ট্রাক, ট্যাংকলরি, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ মালিক শ্রমিক ঐক্যপরিষদ চাঁদা নেয় ১০ টাকা এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটি সংগঠন পরিচালনা ব্যয় বাবদ চাঁদা নেয় ১০ টাকা। যমুনা সেতুর উপরে ওঠার আগে সেখানকার ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয় ১০০ টাকা। মির্জাপুর ট্রাফিক পুলিশ নেয় আরো ১০০ টাকা। ঢাকার প্রবেশ পথ গাবতলীতে ট্রাফিক পুলিশ নেয় ১০০ টাকা। এরপর তেজগাঁও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান সমিতিকে দিতে হয় ৫০ টাকা। ১৭টি স্থানে বিভিন্ন সংগঠন ও ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাবদ চালক রতনকে গুনতে হয়েছে ৮৩০ টাকা। এর বাইরে মোহনপুর সেতু পারাপার ১০০ ও যমুনা সেতু পারাপারের জন্য দিতে হয়েছে ৮৫০ টাকা। সব মিলিয়ে ঠাকুরগাঁও থেকে রাজধানীর কাওরান বাজার আসতে ১৯টি স্থানে চালক রতনকে দিতে হয়েছে সর্বমোট ১৭৮০ টাকা। শুধু রতনই নয়, ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মালবাহী ট্রাক নিয়ে আসা প্রত্যেক চালককে প্রতিদিন এই হিসাবে চাঁদা দিতে হচ্ছে। একই অবস্থা দিনাজপুর থেকে আসা ট্রাকচালক রহিমের। তিনি বলেন, শ্রমিক ইউনিয়ন-মালিক সংগঠনগুলো চাঁদা নেয়। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ অযথাই সড়কে হয়রানি করে। নিয়ম আছে রাজধানীতে রাত ১০টার আগে প্রবেশ করা যাবে না। আমরাও প্রবেশ করি না। কোনোদিন যদি একটু তাড়াতাড়ি চলে আসি তবে গাবতলীর অদূরে দাঁড়িয়ে থাকি। যখন রাত ১০টা বাজে তখনই শহরে প্রবেশ করি। তারপরও ট্রাফিক পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। চালক রতন জানান, প্রায় ৫ বছর ধরে এই লাইনে কাজ করি। দিনাজপুরের দশমাইলের মোখলেছুর রহমানের ট্রাকটি দুই বছর ধরে চালাই। ঠাকুরগাঁও থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামালের ট্রিপ নিয়ে মাসে ১০ থেকে ১২ বার ঢাকায় আসি। মাসিক ৩ হাজার টাকা নির্ধারিত বেতনে কাজ করি। এর বাইরে ট্রাকের মালিক প্রতি ট্রিপের জন্য ৩ হাজার ও সড়কে চাঁদা দেয়ার জন্য আরো দুই হাজার টাকা দেন। রতন বলেন, শুনেছি ৫ বছর আগে যারা কাঁচামাল নিয়ে কাওরান বাজার আসতেন তাদের এত টাকা চাঁদা দিতে হতো না। কিন্তু এখন যতদিন যাচ্ছে চাঁদার পরিমাণ বাড়ছে। আমরা যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করি তাদের সাহায্য করার জন্য এসব চাঁদা নেয়া হয়। কিন্তু আমরা যখন আহত হই বা আমাদের মধ্যে যদি কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তাদের কোনো সাহায্য করা হয় না। অথচ শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আমাদের ৭ হাজার টাকা খরচ করে কার্ড নিতে হয়। রতন বলেন, সড়কে নামে-বেনামে সংগঠনগুলো ও ট্রাফিক পুলিশ চাঁদা নেয়। গাড়ির সকল কাগজপত্র ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও ট্রাফিক পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। না দিলে উল্টাপাল্টা মামলা দিয়ে দেয়। রতন বলেন, সড়কে যদি এসব চাঁদাবাজি বন্ধ করা যেত তবে বাজারে কাঁচামালের মূল্য আরো কম হতো। ট্রাক মালিকরা আমাদের আরো টাকা বাড়িয়ে দিতো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাওরান বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের ঠাকুরগাঁও থেকে এক ট্রাক কাঁচামাল আনতে ১৭ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। কিছুদিন আগেও ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় এসব ট্রাক আসতো। খরচ বাড়ায় অনেক সময় কাঁচামালের মূল্যও বেড়ে যায়। চালকরা জানান, খরচ বেড়েছে সেই সঙ্গে বেড়েছে নিত্য নতুন কৌশলে চাঁদা আদায়ের মাত্রা। ঠাকুরগাঁও থেকে কাওরান বাজার আবার কাওরান বাজার থেকে ঠাকুরগাঁও পৌঁছাতে ১৬০ লিটার ডিজেল লাগে যার আনুমানিক মূল্য ১০ হাজার ৪০০ টাকা। এছাড়া চালক-শ্রমিক খরচ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাঁদা দিতে হয় আরো কয়েক হাজার। যার কারণে কম টাকায় ট্রিপ নিয়ে আসা কষ্টকর। তবে ফেরার পথে কিছু প্রাইভেট কোম্পানির পণ্য ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুরে নিয়ে গেলে বাড়তি কিছু টাকা আসে। তবেই কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু সব সময় এটা সম্ভব হয় না। শুধু ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর নয় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসা এসব ট্রাক থেকে সড়কে আদায় করা হয় চাঁদা। রুটভেদে, গাড়ি ভেদে এই চাঁদার পরিমাণ উঠানামা করে। কাওরান বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পথে পথে চাঁদা আদায়ের কারণে ভাড়া বাড়ে। এতে পণ্যের দামও বেশি নিতে হয়। মেসার্স ফরহাদ ট্রেডার্সের মো. মুসলিম পাটোয়ারী বলেন, আগে অনেক কম ভাড়ায় পণ্য আনা যেতো। এখন ভাড়া বেড়ে গেছে। চালকরা বলেছেন পথে পথে চাঁদা দেয়ার কারণে বাড়তি খরচ হয়। এটি ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হয়।
মহাসড়কে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের উপ-মহা পরিদর্শক মো. আতিকুল ইসলাম মানবজমিনকে জানান, ঢালাওভাবে কোনো অভিযোগ আমরা নিই না। যেসব এলাকায় রিসিট দিয়ে চাঁদা নেয়া হয় সেসব এলাকায় আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=92203