১৬ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪০

যান্ত্রিক স্বল্পতায় কাজ ব্যাহত

চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি ও রফতানিমুখী কন্টেইনার পরিবহন বার্ষিক ১৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিপিং নির্ভর বৈদেশিক বাণিজ্য হচ্ছে প্রসারিত। তবে দেশের এই প্রধান বন্দরে অত্যাবশ্যকীয় ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের (ইকুইপমেন্টস) ঘাটতি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে। এতে করে পণ্যসামগ্রী উঠানামার নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম হচ্ছে গুরুতরভাবে ব্যাহত। এ মুহূর্তে বন্দরে চাহিদার বিপরীতে ৬০ ভাগই যান্ত্রিক সরঞ্জাম রয়েছে অপ্রতুল। অধিকাংশ যন্ত্রপাতি সেকেলে ও জরাজীর্ণ। জোড়াতালি দিয়ে সারানো হচ্ছে কাজকর্ম। বন্দরে কন্টেইনার জটের এটি প্রধান কারণ। যান্ত্রিক ঘাটতি বা সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে চলছে মোটা অঙ্কের ঘুষ-বকশিশ আর ‘স্পিডমানি’র কারবার। নেপথ্যে দুর্নীতিবাজ অপারেটর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি চক্র গড়ে উঠেছে, যারা ব্যবসায়ীদের কৌশলে জিম্মি করে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে ১১শ’ ২০ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের পরিকল্পনা ঝুলে আছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২শ’ ৫০ কোটি টাকা মূল্যের আংশিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। এতে সমস্যা-সঙ্কটের তেমন উন্নতি হয়নি। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ আশাবাদী, শিগগিরই যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি নিরসন হবে। এরজন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

চাহিদার নিরিখে অত্যাবশ্যকীয় ভারী যন্ত্রপাতির অভাবে দক্ষতা ও সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম বন্দর। গত ১ আগস্ট থেকে বন্দর কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা সচল কার্যকর করা হলেও এ ক্ষেত্রে যান্ত্রিক ঘাটতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কন্টেইনার ছাড়াও খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) পণ্যসামগ্রী উঠানামার উপযোগী অপরিহার্য যন্ত্রপাতির ঘাটতিও ব্যাপক। যান্ত্রিক সরঞ্জামের সঙ্কট দ্রæত নিরসন করে বন্দরকে সত্যিকার অর্থে সচল, গতিশীল ও সেবাদাকারী প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার জন্য বন্দর ব্যবহারকারীরা তাগিদ দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তারা সতর্ক করেছেন, ইকুইপমেন্টস ও অবকাঠামোর ঘাটতির পরিণামে রফতানি বাণিজ্যে আরও চরম খেসারত দিতে হবে অদূর ভবিষ্যতে। কেননা বন্দরে পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিংয়ের চাপ ও চাহিদা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। অথচ সেই সমানুপাতে যন্ত্রপাতির ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে না। আমদানি-রফতানি কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে যান্ত্রিক সরঞ্জামের স্বল্পতায় পণ্য উঠানামা বিলম্বিত হচ্ছে। বন্দরের স্বাভাবিক গতি ধীর হয়ে পড়েছে। বন্দরের সার্বিক গতি ও উৎপাদনশীলতায় পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

বন্দরের সর্ববৃহৎ কন্টেইনার স্থাপনা নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), সিসিটি, জেনারেল কার্গো বার্থে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সরঞ্জাম খুবই অপ্রতুল। বন্দরে গত এক যুগেও অনেক ধরনের অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়নি। এনসিটি, সিসিটি, জেসিবি মিলিয়ে রয়েছে ১৯টি জেটি-বার্থ। এ অবস্থায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে গত ২৫ জুন সিসিটিতে ভিড়ার সময় একটি বিদেশি জাহাজ ‘এমভি এক্সপ্রেস সুয়েজে’র বেপরোয়া আঘাতে সবচেয়ে দামী ও গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম দু’টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে। গিয়ারলেস (ক্রেনবিহীন) জাহাজের কন্টেইনার খালাস কাজে সঙ্কট চলছে। গিয়ারলেস জাহাজের আগমনও বেড়েছে।

দেশের মোট আমদানি-রফতানি পণ্যপ্রবাহের ৯২ ভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এর মধ্যদিয়ে কাস্টমস, কর ও অন্যান্য বিভাগ এবং বন্দরের রাজস্ব আয় আসছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরে বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট পণ্যসামগ্রী প্রায় ৮ কোটি মেট্রিক টন এবং ২৪ লাখ ১৮ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। জাহাজের গমনাগমন ২ হাজারেরও বেশি। গত এক দশেকের গড় হিসাব অনুযায়ী খোলা সাধারণ পণ্যখাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ এবং কন্টেইনারে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দর বিভিন্ন ধরনের ভারী, মাঝারি ও হালকা ধরনের ইকুইপমেন্ট সঙ্কটে ধুঁকছে প্রায় এক দশক যাবত। যান্ত্রিক সরঞ্জাম ব্যবহারের চাহিদার বিপরীতে শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ (স্থাপনাভেদে) পর্যন্ত ঘাটতি দিয়েই কাজকর্ম সারানো হচ্ছে। যান্ত্রিক প্রাপ্যতার হার গড়ে মাত্র ৪০ ভাগ। যান্ত্রিক সরঞ্জাম ঘাটতির কারণে বন্দর-ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেই বাড়তি ব্যয় আমদানিকারক, ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিকভাবে গুণলেও পরবর্তীতে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেশের ভোক্তা সাধারণের কাছ থেকেই উসুল করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরে ১১শ’ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১ ধরনের আধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য ৬ বছর আগে পরিকল্পনা নেয়া হয়। তা এখনও ঝুলে আছে। মুনাফালব্ধ বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়ন বাবদ এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের অদূরদর্শিতা, সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বন্দরে যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। বন্দরে কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের স্বল্পতাসহ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অধিকাংশ যন্ত্রপাতির সঙ্কট তীব্র। যান্ত্রিক ঘাটতিকে পুঁজি করে দুর্নীতিবাজ চক্রের ঘুষ বকশিশ স্পিডমানির ‘রেইট’ বেড়েছে। পণ্য খালাস, ডেলিভারি, জাহাজীকরণ, স্টেক-মজুদ করাসহ কার্গো হ্যান্ডলিং বিলম্বিত হচ্ছে। যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্পে রয়েছে ১০টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রীচ স্ট্র্যাকার, কন্টেইনার মোভার, রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন। যা কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভারী যন্ত্রপাতি। এছাড়া কন্টেইনার ও খোলা সাধারণ পণ্য উঠানামার উপযোগী বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জামের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/104495