১৬ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৯

গরিবের থালা থেকে সবজি প্রায় উধাও

গত এক মাসে সন্তানদের একদিনও শাক খাওয়াতে পারেননি পোশাক শ্রমিক আমেনা বেগম। অথচ চোখের সমস্যার কারণে তার বড় ছেলেকে বেশি করে শাক খাওয়াতে বলেছেন চিকিৎসক। শুক্রবার ছুটির দিনে ভেবেছিলেন কিনবেন। কিন্তু রাজধানীর আদাবর বাজারে গিয়ে ফিরেছেন ১১০ টাকা কেজিতে একটি মুরগি ও ২০ টাকায় এক কেজি আলু নিয়ে। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, 'শাকে হাত দেওন যায় না। এক আঁটি লালশাক ২৫ টাকা চাইল। আমার লাগত তিন আঁটি। কী আর করুম! ফার্মের মুরগি আর আলুই ভরসা।' ছেলেকে শাকসবজি খাওয়াতে পারছেন না, সেই আক্ষেপ করে আবার বললেন, 'আমরা গরিব মানুষ কীভাবে বাঁচুম! শাকসবজির দাম তো অহন মাছ-মাংসের চাইতেও বেশি!' পাশেই ছিলেন আরেকজন নিম্ন-আয়ের মানুষ সাথী আক্তার। তিনিও কিনেছেন মুরগি। বললেন, 'শাকসবজির ভিটামিন খাওয়া লাগব না। ডাক্তার কইলে কয়টা ভিটামিন ট্যাবলেট খায়া ফেলুম।'

শুধু আমেনা বা সাথী নন; রাজধানীর নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের অনেকেই এখন চড়া দামের কারণে শাকসবজি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। সংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও। শুক্রবারের চার দিন পর গতকাল বুধবার বাজারে শাকসবজির দাম কিছুটা কমলেও এখনও আকাশচুম্বী। গত বছর নভেম্বর মাসের সঙ্গে তুলনা করলে এই দাম এবার কেজিতে সর্বনিম্ন ৩৬ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। শুধু পুরনো আলুর দাম গতবারের চেয়ে এই সময়ে কেজিতে কমেছে ১০ শতাংশ। গত বছর নভেম্বরে আলুর কেজি ছিল ২২ থেকে ২৫ টাকা, আর এবার ২০ থেকে ২২ টাকা। কাঁচা পেঁপের কেজি গতবারের সমানই রয়েছে, ২০ থেকে ২৫ টাকা।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, পুরোদমে শীত শুরু না হলেও বাজারে মোটামুটি চলে এসেছে মৌসুমি শাকসবজি। তবে সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় দাম আর খুব বেশি কমার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। দীর্ঘমেয়াদি বন্যার পর অতিবৃষ্টিতে শাকসবজি নষ্ট হওয়াই এর অন্যতম কারণ। বৃষ্টির পর নতুন করে যেসব সবজি বোনা হয়েছে, সেগুলো বাজারে আসতে আরও দেরি হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ সমকালকে জানান, গত বছর ৭ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৫৯ হাজার টন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার সবজির উৎপাদন কিছুটা কম।

স্বল্প আয়ের মানুষ শাকসবজি খাওয়া কমিয়ে দিয়ে আলু খাওয়া বাড়ানোয় বিপত্তি দেখছেন চিকিৎসক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, একজন মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম শাকসবজি খেতে হয়। সেখানে এ দেশের মানুষ এমনিতেই দিনে জনপ্রতি ২০০ গ্রামের বেশি সবজি খায় না। এবার দামের কারণে সেটা যদি আরও কমে, তাহলে জনস্বাস্থ্যে বিশেষ করে গরিব মানুষের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

যারা কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের বেশি শাকসবজি খেতে হবে। শাকসবজিতে রয়েছে ভিটামিন সি, ই, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ শরীর সুস্থ রাখার নানা উপাদান। বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. ফারিয়া মোর্শেদ বলেন, দীর্ঘদিন শাকসবজি না খেলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এতে নানা ধরনের অসুস্থতায় চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ে। শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য বেশি বেশি টাটকা শাকসবজি খাওয়াতে হবে।

বাজার চিত্র, দরদাম ও ক্রেতাদের বক্তব্য :গতকাল বুধবার মিরপুর ৬ নম্বর সেকশন কাঁচাবাজারে ৭০ টাকায় বিক্রি হয় প্রতি কেজি শিম। নতুন শিম বাজারে ওঠার সময় দাম ছিল ২০০ টাকা বা তার বেশি। ফুলকপি প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায় আর বাঁধাকপি ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। বাজার করতে আসা চিকিৎসক জাকিরুল আলম স্বপন বলেন, ৫০০ টাকার বাজার করলাম, অথচ ব্যাগ ভরেনি। চড়া দামের কারণে সুস্বাদু সবজি যেন বিস্বাদ লাগছে। তার পরও সন্তানদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে বাড়তি দামেই সবজি নিয়েছি। শিম ৭০ টাকা এবং বেগুন ৬০ টাকা কেজিতে নিলাম। লাল শাক ও সরিষা শাক ২০ টাকা আঁটি আর পালংশাক ৫০ টাকা কেজি নিয়েছি।

গতকাল সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে আসা এনজিও কর্মকর্তা আবদুল খালেক বলেন, অফিস ছুটির পর কারওয়ান বাজার এলাম। এখানে মহল্লার চেয়ে সবজির দাম কম। ২৫ টাকায় ফুলকপি ও ৫০ টাকায় লাউ কিনেছি। বেশি দামের কারণে অনেক দিন সবজি কেনা হয় না। গিন্নি খুশি হবে টাটকা সবজিতে। কারওয়ান বাজারের খুচরা মার্কেটে কথা হয় পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান আশিক হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাই, আলু কিনলাম পাঁচ কেজি, এখন ডাল কিনব। আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে দিন পার করছি। ছোট মেয়েটা টিভিতে শীতের গাজর ও ফুলকপির ছবি দেখে খাওয়ার বায়না ধরেছে। কিন্তু সম্ভব না, যে দাম! ক'দিন পরে দাম কমলে কিনব।

ফার্মগেট মোড়ে ঘড়ি মেরামত করেন তায়েব আলী। কারওয়ান বাজারে সপ্তাহে দু'দিন সবজি কেনেন। বাসা থেকে আসার সময় নতুন ফুলকপি ও বেগুন নিতে বলেছে তাকে। বেগুনের দাম শুনেই বিক্রেতাকে ধমকাতে লাগলেন তিনি- '৮০ টাকা বেগুনের কেজি, এটা কি রোজার মাস পাইছিস?' পাশের বিক্রেতা হরেক রকম শাকের আঁটিতে পানি ছিটাতে ছিটাতে তায়েবকে উদ্দেশ করে বলেন, ভাই, নতুন শাক নেন। তিনি পালং শাকের আঁটি দেখিয়ে দাম জিজ্ঞেস করেন। বিক্রেতা বলেন, '২৫ টাকায় ব্যাচছি, আপনার জন্য ২০ টাকা আঁটি।' এ দফায়ও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন তায়েব আলী।

গুলশান নিকেতনের পশ্চিম গেটের কাছের কাঁচাবাজারে ১০০ টাকা কেজিতে নলা মাছ কিনছিলেন রিকশাচালক মুখলেছ খান। পলিথিনে পেঁচিয়ে মাছটি যাত্রীদের বসার সিটের নিচে রাখলেন। তার রিকশায় নিকেতনের ৪ নম্বর গেটের কাছে আসতে আসতে কথা হয়। মাছ কী তরকারি দিয়ে রান্না করবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তরকারির যা দাম, ঝোল করে খাব। শাকসবজি খাওয়া তো ভুলেই গেছি।'

বিক্রেতারা যা বলেন :কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা জব্বার শেখ জানালেন, আগে গার্মেন্ট শ্রমিক ও গবির মানুষ মাছ-মাংসের দাম বেশি থাকায় শাকসবজি খেত বেশি। কিন্তু তারা শাকসবজি খাওয়া বাদ দিয়েছে।

সবজি বিক্রেতা তারা মিয়া জানান, পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, তার চেয়ে কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করি। পাইকাররা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সবজি কিনছে। তারাই শাকসবজির মূল মুনাফা লুটে নিচ্ছে। এ অভিযোগ অস্বীকার করেন পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী আক্কাছ আলী। তিনি বলেন, শাকসবজি একটি কাঁচামাল। ভোর হওয়ার আগে বিক্রি করতে না পারলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পচন ধরে। লোকসানে পড়তে হয়। সবজির বাজার কারও নিয়ন্ত্রণে নেই দাবি করে তিনি বলেন, সরকারের তদারকি না থাকায় খুচরা বিক্রেতারা হাট ও মহল্লা বেঁধে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি করে থাকে। ভ্যানে এক দামে আর বাজারে আরেক দামে ভোক্তাদের সবজি কিনতে হয়।

কৃষকের বক্তব্য :দেশে শাকসবজি উৎপাদন বেশি হয় এমন এলাকার কৃষকরা জানান, ভোক্তারা সবজির চড়া দাম দিলেও এর পুরোটা তারা পাচ্ছেন না। কৃষক থেকে ভোক্তা, মাঝখানে কয়েক দফা হাত বদল। এতে দামের ফারাক কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। সবজির মুনাফা লুটে নিচ্ছে পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা। রাস্তায় সবজির ট্রাকে পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের চাঁদাবাজি এবং পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিকে অজুহাত দিচ্ছেন পাইকাররা।

বগুড়ার শাজাহানপুরের মাদলা এলাকার কৃষক রফিকুল সরকার বলেন, শুরুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকলেও এখন সবজি ফলছে। সবজি বিক্রি করে তিনি লাভের মুখ দেখেছেন। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের সবজি চাষি আলী আকবর বলেন, এবার তিনি বেগুন ও লাউয়ের চাষ করেছেন। সঙ্গে পুঁই শাক ও লাল শাক। ইতিমধ্যে পাইকারদের কাছে দুই চালান বিক্রি করেছেন। বৃষ্টির সঙ্গে লড়াই করে এবার ভালো দামে সবজি বিক্রি করতে পারায় তিনি খুশি। হিসাব কষে এবার ভালো মুনাফার কথা জানান তিনি।

সাভারের বিরুলিয়ার কৃষক রুমালী খান বলেন, তিনি মুলা ও পালং শাক চাষ করেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে ১০ টাকা আঁটি ধরে বিক্রি করছেন। এতে তার ভালো লাভ হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুমালীর বিক্রি করা শাকের আঁটি তিন কিলোমিটার দূরে মিরপুর ১ নম্বরের শাহআলী মাজারের সামনের রাস্তায় ১৫ টাকায় বিক্রি হয়। তার চেয়ে আরও এক কিলোমিটার দূরে মিরপুরের ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় বসা সকালের অস্থায়ী হাটে এক আঁটি মুলা শাক বিক্রি হয় ২০ টাকায়। এভাবেই হাত বদলে দামের পারদ ওপরে উঠতে থাকে। ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকার ভোক্তাকে আরও বেশি দামে সবজি কিনতে হয়।

 

http://samakal.com/bangladesh/article/17111014