১৬ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৪

চলছে জনগণকে তুচ্ছজ্ঞান করার অপরাজনীতি

বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর আচার-আচরণে সন্তুষ্ট নয় পৃথিবীর সাধারণ মানুষ। আবার উত্তর কোরিয়ার বেপরোয়া আচরণে বেজায় অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রগুলো। আসলেই অদ্ভুত ও অনাকাক্সিক্ষত এক বিশ্বব্যবস্থায় এখন আমাদের বসবাস। এমন এক প্রেক্ষাপটে এশিয়া সফর করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উত্তর কোরিয়া ইস্যু সমাধানে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের প্রতি আরও বেশি কিছু করার এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। চীন সফরের দ্বিতীয় দিনে ৯ নভেম্বর বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব পিপল-এ আয়োজিত অনুষ্ঠানে ট্রাম্প ওই আহ্বান জানান। বর্তমান পৃথিবীতে নানা ইস্যুতে বৈঠক হয়, আহ্বান জানানো হয় কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয় কতটুকু? বিশ্বনেতাদের অনেক তৎপরতাকে এখন প্রহসন ও প্রতারণামূলক বলেও মনে হয়।

বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতির নানা বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ হচ্ছে, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন মন্তব্যও। উত্তর কোরিয়াও এর মধ্যেই আছে। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে বেপরোয়া মনোভাব প্রদর্শন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের চিন্তার কারণ হয়ে আছেন। তবে বিশ্লেষকরা প্রসঙ্গত পুরানো একটি প্রবাদের কথা এখন স্মরণ করছেন। আলোর নিচেই নাকি থাকে অন্ধকার। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে প্রবাদটি খেটে যেতে পারে বলে মনে করেন তারা। কারণ উত্তর কোরিয়ার জনগণই দেশটির শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় মাথাব্যথার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। উল্লেখ্য যে, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে সৃষ্ট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা নিরসনে সবাই দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টির কথা বলছে। কিন্তু দেশটির অভ্যন্তরে কি ঘটছে, জনগণ কি ভাবছে, সে দিকে কারও তেমন মনোযোগ নেই।

চলতি বছরের শুরুর দিকে জাতিসংঘ জানিয়েছিল, উত্তর কোরিয়ার ৪৪ লাখ মানুষ ক্ষুধাপীড়িত। এই সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। এছাড়া দুই দশকের কম সময় আগে উত্তর কোরিয়ায় দুর্ভিক্ষে ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়। উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী জিহাইয়ুন পার্ক বলেন, সহ্যসীমার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে জনগণ। প্রিয় নেতা, মহান দেশের প্রতি ৬০ বছর ধরে আস্থা রেখে এসেছে উত্তর কোরিয়ার জনগণ। কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পায়নি তারা। এভাবে বেঁচে থাকতে থাকতে তারা এখন ক্লান্ত। জিহাইয়ুনের মতে, কিম জং-উন হয়তো কর্তৃত্বপরায়ণ শক্তিগুলো থেকে, বাকি বিশ্বের হাত থেকে বেঁচে যাবেন। কিন্তু তিনি নিজের জনগণকেই ভুলে গেছেন। কিম জং-উন পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার নেশায় মত্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি খেয়ালই করছেন না, উত্তর কোরিয়ার জনগণ আর আগের মত বাধ্যগত নেই। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে দেশটির জনগণের। হাজারো মানুষ উন্নত জীবনের আশায় উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়েছে। এই মানুষেরা ফাইটার্স ফর নর্থকোরিয়ার মত সংগঠন গড়ে তুলেছে। এই সংগঠন ইউএসবি ড্রাইভ, ডিভিডি ও গণতন্ত্রপন্থী লেখা স্লোগান বেলুনে বেঁধে উত্তর কোরিয়ায় ফেলছে। উত্তর কোরিয়ার জনগণের সক্রিয় হয়ে ওঠার বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে মন্তব্য করেন জিহাইয়ুন পার্ক। পার্কের মন্তব্য আমাদের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যুদ্ধংদেহী স্বৈরশাসকরা যখন জনগণকে তুচ্ছজ্ঞান করেছে, তখন তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আর বিচ্ছিন্ন স্বৈরশাসকরা সবসময় পরাজিত হয়েছে জনগণের কাছে।

বর্তমান সভ্যতায় জনগণকে তুচ্ছজ্ঞান করা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও তেমন চিত্র লক্ষ্য করা যায়।
ছয় নারীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ ও সেসব দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতা আরিফ হোসেন হাওলাদারকে ১১ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত আটক করতে পারেনি পুলিশ। ১২ নভেম্বর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীদের একজন আরিফ হোসেনের (২২) বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন। এদিকে আপত্তিকর ভিডিও দৃশ্য ও ছবি এখনো ইন্টারনেটে ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আরিফ শরিয়তপুরের নারায়ণপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ফেরাঙ্গিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা এবং স্থানীয় একটি কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। ধর্ষণ ও সেই দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে এক নারী এখন এলাকাছাড়া, দু’জন কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, আরেক নারীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। স্নাতক শ্রেণির ছাত্র, তিনি আবার ছাত্রনেতা- তার এসব কর্মকা-কে সমাজ কীভাবে মূল্যায়ন করবে? একজন ছাত্র ও নেতার কাজ সমাজের জন্য কেমন হওয়া উচিত ছিল? আর তিনি যা করলেন, তা কেমন করে করলেন? তিনি তো জনমানবহীন কোনো জঙ্গলে গিয়ে ওইসব অপকর্ম করেননি। অপকর্মগুলো তিনি সমাজেই করেছেন এবং সাহসের সাথেই করেছেন।
আমাদের সমাজ কি তাহলে পচে গেছে? সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো কি অকার্যকর হয়ে পড়েছে? আর ক্ষমতাসীন দলের কোনো পর্যায়ের নেতা অপরাধী হলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন অক্ষম হয়ে পড়ে? সমাজকে মানুষের বসবাসযোগ্য রাখতে হলে ওই প্রশ্নগুলোর জবাব জানা প্রয়োজন।

ভুক্তভোগী নারীদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আরিফকে আটক না করায় তারা আতঙ্কে আছেন। আর আরিফের গ্রামের লোকজন বলছেন, এমন ঘটনায় তারাও অস্বস্তি ও লজ্জায় পড়েছেন। আরিফকে আটক না করলে এরকম আরও অঘটন ঘটে কিনা, তা নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়। এ প্রসঙ্গে ভেদরগঞ্জ থানার ওসি মো. মেহেদি হাসান বলেন, আরিফকে গ্রেফতারে তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করছেন। আমরা জানি, পুলিশ আন্তরিক হলে অনেক কিছুই করতে পারেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে তারা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে সঠিক কাজটি করবেন বলে আমরা আশা করি। এদিকে ঘটনা জানাজানির পর আরিফকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। ১১ নভেম্বর তাকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারের এমন ঘটনা নতুন নয়। অতীতেও আমরা দেখেছি, যখন এ ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটে, নেতার জন্য সংগঠন ইমেজ-সংকটে পড়ে যায়, তখন বহিষ্কারের বিবৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু এতে কি সংগঠনের নেতাদের অপকর্মের ধারা বন্ধ হয়েছে? হয়নি, বরং অপকর্মের ধারা অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন জাগে, আরিফ কি হঠাৎ করেই ধর্ষণ ও ওইসব দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে? আসলে দীর্ঘদিনের প্রশ্রয় ও ক্ষমতার দাপটের কারণেই সে ওইসব কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। যারা এখন বহিষ্কার করছেন তারা কি আরিফের স্বভাব-চরিত্র তথা আমলনামা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না? না জেনে কি কাউকে একটি এলাকায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক করা যায়? আসলেই সংগঠনকে এবং নেতাদের দূষণ মুক্ত করতে চাইলে শীর্ষ নেতাদেরও আত্মসমালোচনার সাথে সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

 

http://www.dailysangram.com/post/307736