১৫ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:১৩

ছয় সিটি নির্বাচনের সুষ্ঠুতা জাতীয় নির্বাচনের পথ সুগম করবে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে দেশের ৬টি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে গণমাধ্যম ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়। রংপুর, গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন এ নির্বাচন কর্মসূচির আওতায় আসবে। এগুলোর মধ্যে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্য ৫টির নির্বাচন ২০১৮ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে জানা যায়। দেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষদিকে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হয় তার ওপর নজর রাখবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোসহ সচেতন জনগণ। উল্লিখিত সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচন কেন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হওয়া প্রয়োজন তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় সিটি কর্পোরেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯-এ সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব ও কার্যাবলী নির্ধারণ করে দেয়া আছে। এ আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, কর্পোরেশন তহবিলের সঙ্গতি অনুযায়ী তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত দায়িত্ব ও কার্যাবলী সম্পাদন করবে। তাছাড়া বিধি এবং সরকার কর্তৃক সময় সময় প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী কর্পোরেশন অন্যান্য দায়িত্ব ও কার্যাবলী সম্পাদন করবে। তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত দায়িত্ব ও কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে- জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে হাসপাতাল ও ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মাতৃসদন স্থাপন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা শৌচাগার নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, আবর্জনা অপসারণ, সংগ্রহ ও এর ব্যবস্থাপনা, সাধারণ ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থাকরণ, পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন, নর্দমা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, জনসাধারণের গোসল করা, কাপড় ধোয়া ও শুকানোর জন্য উপযুক্ত স্থান নির্দিষ্টকরণ, লাইসেন্স ছাড়া খাদ্য বা পানীয়দ্রব্য তৈরি বা বিক্রি নিষিদ্ধকরণ, খাদ্যদ্রব্য, পানীয় ও পশু বিক্রির জন্য বাজার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর বস্তুর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এক বা একাধিক স্থানে মাংস বিক্রির উদ্দেশ্যে পশু জবাই বা কসাইখানা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ইমারত নিয়ন্ত্রণ, সড়ক ব্যবস্থাপনা, মোটরযান ছাড়া অন্য ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা এবং রাস্তা ধোয়া ও পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ, গোরস্তান ও শ্মশানঘাট ব্যবস্থাপনা, গাছ-পার্ক-উদ্যান ও বন নিয়ন্ত্রণ, পুকুর ও জলাধার নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে সহায়তা প্রদান, সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ, সরকারের অনুমোদনক্রমে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এ কার্যাবলী থেকে যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল, নগর জীবনে নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও তাদের নিরাপদ জীবনযাপনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব মূলত সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত। তাই সিটি কর্পোরেশনগুলোতে উপযুক্ত মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন ২০০৯ এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯-এ সংশোধনী আনার আগ পর্যন্ত এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা নির্দলীয়ভাবে নির্বাচিত হতেন। ২০১৫ সালে এসব আইনে সংশোধনী এনে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার প্রধান নির্বাহী মেয়র পদে এবং উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রধান নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নের বিধানে পরিবর্তন আনা হয়। এতে বলা হয়, এসব পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হবে। সে সময় বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এবং দেশের বিশিষ্টজনরা সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। সরকারের সিদ্ধান্তকে বিএনপি দুরভিসন্ধি আখ্যায়িত করে বলে, দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচন রাষ্ট্র ও সমাজে বিভাজন তৈরি করবে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দুই জোটের বাইরে থাকা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। তারা বলে, এতে করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আরও সংকুচিত ও দুর্বল হবে। সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী বিশিষ্টজনরা বলেন, নির্দলীয় নির্বাচনে প্রার্থী দল-মত নির্বিশেষে ভোট পাওয়ার আশায় নিজেকে সৎ, সভ্য ও সজ্জন হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকত। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে তা তিরোহিত হবে। রাজনীতির বাইরেও সৎ ও যোগ্য লোক সমাজে আছে। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে এসব সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি তৃণমূল পর্যায়ে সমাজকে নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ পাবেন না। সমাজের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া দলীয়ভাবে নির্বাচনে বড় বড় রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্য হবে।

ছয় সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শাসক দল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইতিমধ্যে তাদের মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন পর্যন্ত তাদের মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। আশা করা যায়, তারাও শিগগির তাদের প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তা পরবর্তী ৫ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহিত করবে। রংপুর সিটি কর্পোরেশনে সুষ্ঠু ভোটের নজির প্রতিষ্ঠা নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় ধরনের পরীক্ষা। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রংপুর সিটি কর্পোরেশনে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। রংপুরের তফসিল ঘোষণার পরপরই মাঠে নামানো হয়েছে ৬টি ভ্রাম্যমাণ আদালত। সিটি এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাৎক্ষণিক দণ্ড দিতেই এ ব্যবস্থা। প্রার্থীর প্রচারে ব্যবহৃত বিলবোর্ড, পোস্টার অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিটি এলাকায় নতুনভাবে ভিজিএফ কার্ড ইস্যু না করা এবং কোনো ধরনের অনুদান না দেয়ার জন্য কমিশন থেকে সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্যই কমিশনের এসব পদক্ষেপ। তবে পত্রপত্রিকায় ইতিমধ্যে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিধিমালা লঙ্ঘনের দায় থেকে কেউ যেন ছাড় না পায় তা কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। কমিশনকে লক্ষ রাখতে হবে যেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার না হন এবং তাদের মনোনয়ন দাখিলে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না করা হয়। অন্যথায় সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি সম্ভব হবে না এবং নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে দাবি মানাতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট এবং জোটের বাইরে ৯টি সমমনা দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ওই নির্বাচন অনেকটা একদলীয় নির্বাচনে রূপ নেয়। এতে দেশে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া তৎকালীন নির্বাচন কমিশন দশম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আবার বিশ্বাস স্থাপন করতে শুরু করেছে। রংপুরসহ ৬ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে তা নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের বিশ্বাস বহুলাংশে ফিরিয়ে আনবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবে। এতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/window/2017/11/15/171829