১৫ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:১৩

জামায়াতের আমীরের রিমান্ড ও খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলা রাজনীতির জন্যে ভালো নয়

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

(এক)
অ্যাডলফ হিটলার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে কাল্পনিক শত্রুর সৃষ্টি করতে হবে। এতে জনসাধারণ ভীত হয়ে পড়বে। জনগণ ভীত হলেই তাদের দাসে পরিণত করা সহজ। বর্তমানে বাংলাদেশে এখন আওয়ামী নৈরাজ্যকর শাসন চলছে। গুম, খুন, অপহরণ, হামলা-মামলা, হিংসা-বিদ্বেষ, নৈতিক অবক্ষয় গোটা জাতিকে অগ্নিকুন্ডের কিনারায় পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে অবৈধভাবে আটক করেছে এবং গোপন স্থানে আটকে রেখেছে বলে একটি প্রতিবেদনে বলছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সর্বশেষ যোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক শিক্ষক।

এজন্য স্যার অর্নেস্ট বেন বলেছেন, “বিপদ অন্বেষণ করার কৌশলই হচ্ছে রাজনীতি, বিপদ থাকুক আর নাই থাকুক।” ক্ষমতায় থাকার অসুস্থ রাজনীতি গোটা জাতির জন্য আজ অভিশাপে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক কালচার এখন জাদুঘরে বন্দী। আওয়ামী লীগের নোংরা রাজনীতির অক্টোপাস জাতির সব অর্জনকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী দল ও তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব মকবুল আহমাদ, সাবেক এমপি ও নায়েবে আমীর অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ দলটির শীর্ষ নেতাদেরকে গত ৯ অক্টোবর ঢাকার উত্তরায় একটি বাড়িতে ঘরোয়া বৈঠক থেকে গ্রেফতার করে জনসমর্থনশূন্য অবৈধ সরকারের প্রাণ সঞ্চালনকারী, শক্তিবর্ধক পুলিশবাহিনী।

২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কদমতলী থানার আওতাধীন একটি বাড়ি থেকে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ শাখার আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, নায়েবে আমীর মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ও সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ ১০ জন নেতা-কর্মীকে নাশকতা সৃষ্টি, সরকার উৎখাত এবং বিস্ফোরক দ্রব্য রাখার দায়ে পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাবেক ছাত্রনেতা, পিএইচডি ডিগ্রিধারী, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীনও আছেন। দুর্ভাগ্যজনক চোর-ডাকাতের মতো হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে তাদের আদালতে আনা হচ্ছে। এটি জাতির জন্য লজ্জাজনক। দেশের জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিমান ও যোগ্যদের যখন এই অবমর্যাদাকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয় তখন দেশ কোনদিকে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়।

জনাব মকবুল আহমাদসহ সকল সম্মানিত বয়োঃবৃদ্ধ, উচ্চশিক্ষিত, রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে পরদিন আদালতে পুলিশের পুরাতন ও গদবাঁধা নিয়মেই সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং নাশকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানোসহ বিস্ফোরক দ্রব্য বহনের অভিযোগ আনা হয়। আদালত তাদের বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেন। অথচ অভিযুক্তদের আইনজীবীরা প্রত্যেকটি অভিযোগকেই মিথ্যা, বানোয়াট ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েলে সরকারী কৌশল বলেছেন।

প্রথম দফা রিমান্ডে জনাব মকবুল আহমাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে মকবুল আহমাদের আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোট জনাব মকবুল আহমাদের তিন দিনের রিমান্ড স্থগিত করেছেন। জনাব মকবুল আহমাদ একজন বয়োঃবৃদ্ধ মানুষ। প্রায় ৮০ বছর বয়ষ্কমানুষটি ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপ, হৃদরোগ ও মেরুদণ্ডের ব্যথাসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। রিমান্ডের নামে হয়রানির কারণে তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একজন বয়োঃবৃদ্ধ অসুস্থ মানুষকে মিথ্যা অভিযোগে আটক করে রিমান্ডে নিয়ে, চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত করে সরকার তাঁর সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী একজন নাগরিকদের চলাফেরা, মতামত প্রকাশ, দল বা সমিতি গঠন এবং আইনের আওতায় থেকে তা পরিচালনার অধিকার স্বীকৃত।

মাওলানা মতিউর নিজামীর শাহাদাতের মাধ্যমে আমীরে জামায়াতের শূন্য পদের সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর রুকনগণ (সদস্য) গোপন ভোটের মাধ্যমে ২০১৭-১৯ কার্যকালের জন্য জনাব মকবুল আহমাদকে আমীর হিসেবে নির্বাচিত করেন। ১৭ অক্টোবর নব-নির্বাচিত আমীর শপথ গ্রহণ করেন। অবশ্য জামায়াত নিজেদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা শত প্রতিকুলতার মাঝেও কিভাবে লালন করে এ নির্বাচন দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

জামায়াতের নব-নির্বাচিত আমীরের বক্তব্য দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই নিউজের হেডলাইন ছিলো- “আগামীর পথে জামায়াত” কেউ বলছেন, “যুদ্ধাপরাধ মুক্ত জামায়াত” আবার কেউ বলছেন, “ক্লিন ইমেজের মকবুল আহমাদের নেতৃত্বে জামায়াত” “জামায়াতের আমীরের বক্তব্যে পরিবর্তনের সুর” কেউ বলছেন, এ রকম নানা শিরোনামে নিউজ করছে অনেক মিডিয়া।

কিন্তু অতীতের মতই কিছু সময় পার না হতেই কতিপয় মিডিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে রাজাকার কমান্ডার বানিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। আসলে তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক দেশের মানুষ সকলেই ভালো করেই জানেন। এই ষড়যন্ত্রমূলক ও কল্পকাহীনি দেশের জনগণ প্রত্যাখান করেছে।

জনাব মকবুল আহমাদ কর্মজীবনে একজন সফল শিক্ষক। তৃণমূল থেকে উঠে আসা দ্বীনের এই নিবেদিত প্রাণ মানুষটি এ দেশের জনগণের নিকট খুবই পরিচিত। ব্যক্তি জীবনে বিনয়ী, অল্পেতুষ্ট, পরপোকারী, স্বজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই তিনি সকলের হৃদয়ে আস্থার জায়গা করে নিয়েছেন আপন মহিমায়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানিকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। তিনি সত্যিই একজন সাদামনের মানুষ। যারা তাঁর সাথে মিশেছেন তারাই এর সাক্ষী।

জনাব মকবুল আহমাদ একজন উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন যাবত ইসলামী আন্দোলনের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। প্রতিটি স্থানে তিনি দা’য়ী ইলাল্লাহর কাজে থাকেন সদা তৎপর। তিনি যথাসম্ভব সকল মানুষের খোঁজ-খবর রাখেন। প্রতিটি ব্যক্তির কথা তিনি শুনেন হৃদয় দিয়ে। জীবনে একবার সাক্ষাৎ হয়েছে তিনি তাকেও স্মরণ রাখেন। সুযোগ হলে ফোন করে তার খোঁজ-খবর নেন। এ যে এক অন্য রকম মানুষ। তিনি প্রচন্ড পড়ুয়া মানুষ। নতুন বই কালেকশান করে পড়া যেন তাঁর নেশা। তিনি সকলের নিকট জ্ঞানের মশাল জ্বালতে বই বিতরণ করে থাকেন অনবরত। এই সহজ-সরল আল্লাহর বান্দার বিরুদ্ধে কোন মিথ্যাচার দেশের জনগণ সহ্য করবে না।

জনাব মকবুল আহমাদ জাতির মহাদুর্যোগের নব কান্ডারী, ইসলামী আন্দোলনের অভিভাবক, দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নব-নির্বাচিত জনাব মকবুল আহমাদ দেশের স্বাধীনতা, শান্তি-শৃংখলার স্বার্থে জাতীয় ঐক্যের যে আহবান জানিয়েছেন তা দেশে-বিদেশে সর্বমহলে প্রসংশিত ও সমাদৃত হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের মৌলিক উপাদান শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, পরমত সহিষ্ণুতা ও দেশপ্রেম। এই বক্তব্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা এর মাধ্যমে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে। ইতিহাস একদিন তাঁর মূল্যায়ন করবে। পৃথিবীতে ইতিহাসের লেখক, পাঠক অনেকেই হন কিন্তু ইতিহাসের রচয়িতা দু’এক জনই।

রাজবন্দীদের সম্মান মর্যাদা পৃথিবীর সব জায়গায় রয়েছে। কিন্তু রিমান্ডের নামে নির্যাতন, হয়রানি, অপমান, ডান্ডাবেড়ি, হ্যান্ডকাফ এ সবই এখন রাজনীতিবিদদের প্রতি প্রয়োগ করা এখন অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রিমান্ডের অপব্যবহার পরাধীন বৃটিশ আমলে ছিল না, পাকিস্তান আমলে ছিল না, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল মঈন-ফখরুদ্দীন আমল থেকেই রাজনীতিবিদদের উপর বর্বর নির্যাতন শুরু হয়েছে। শিক্ষা-বয়স-নির্বিশেষে বিরোধী রাজবন্দীদের উপর তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক শিষ্টাচার এখন শূন্যের কোঠায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবেনা। সুতরাং শীর্ষ নেতাদের সাথে এ মার্জনীয় ক্ষমতা অপপ্রয়োগ যে, একদিন আওয়ামী লীগের উপর বর্তাতে পারে তা অসম্ভব নয়।

(দুই)
আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু বাস্তবে স্বৈরাচারী। বিশ্বাসে বাকশাল আর চরিত্রে ফ্যাসিস্ট। বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় বর্তমান মহাজোট সরকার তাদের অপকর্ম ঢাকতে আজ ফ্যাসিস্ট নীতিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে। জেল-জুলুম নির্যাতন আর মামলাবাজি বিপরীত মতের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর চালানো হচ্ছে। এ জন্য তারা ব্যবহার করছে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করতে কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা এ সরকারের অন্যতম হাতিয়ার। অবশ্য আওয়ামী লীগের এ চরিত্র অতীব পুরনো। আওয়ামী লীগ বাকশালী চরিত্র থেকে এক ইঞ্চিও সরে দাঁড়ায়নি। স্বাধীনতার এত বছর পার হলেও আওয়ামী লীগের চরিত্রের খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। তাদের আজকের কার্যক্রম যেন পুরনো দিনের প্রতিধ্বনি-ই মাত্র।

বিদেশী সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ : লেগ্যাসি অব ব্লাড’-এর ৪৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘১৯৭৩ সাল। স্বাধীনতার দ্বিতীয় বছর। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, কালোবাজারি, চোরাচালান আর রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ, রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো। শেখ মুজিব তাঁর রক্ষীবাহিনী আর সশস্ত্র রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে তা প্রতিহত করছিলেন। পক্ষে-বিপক্ষে চতুর্দিকে কেবল অস্ত্র আর অস্ত্রের ঝন্-ঝনানি। সাধারণ মানুষের মধ্যে করুণ নিরাপত্তাহীনতা”। আসলে আওয়ামী লীগ বরাবরই বাংলাদেশকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করত। এ জন্য তার পরিবার বা দলের সমালোচনা বা বিরুদ্ধাচরণকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে মনে করতো।’

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাউথ এশিয়ান মনিটর এক রিপোর্টে লিখেছে-কক্সবাজারে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরে যাওয়ার পথে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। অবশ্য এতে যারা আহত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন গাড়িবহরের সঙ্গে সফরকারী সাংবাদিক। ফেরার পথে তাঁর গাড়িবহর অতিক্রম করে চলে যাওয়ার ঠিক পর মুহূর্তে দুটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনা ঘটে ফেনীতে, বেগম জিয়ার নির্বাচনী এলাকায়। এরপর প্রত্যাশা অনুযায়ী অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ চালাচালি হয়। তবে এ ঘটনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা যে সবচেয়ে অটল ও নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্টর তা আবারো প্রমাণিত হয়েছে।

এই হামলা বিএনপি’র জন্য আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তপনার প্রমাণ। সংবাদ মাধ্যমের ফুটেজে দেখা যায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা হামলা করছে। হামলা যখন চলছিলো তখন পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগ পাল্টা দাবি করে বলেছে তারা হামলা করলে খালেদা জিয়া ও বিএনপি যে বিপুল প্রচারণা পাবে তাতে তাদের কোনো লাভ নেই।

অপ্রত্যাশিত একটি উপাদানের আকস্মিক প্রবেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে খুবই বিরক্তিকর আরেকটি উপাদান যোগ করেছে। খালেদা জিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণের জন্য যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে অধিকতর বিষাক্ত মসলার মতো আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ষড়যন্ত্র এসেও হাজির হয়েছে, যা রাজনীতিকে আরো বেশি অস্থির ও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যদি একটি সংকট হয়, তাহলে সশস্ত্র শক্তিগুলোর পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট উৎকণ্ঠা সৃষ্টিকারী খবরগুলোও নিয়মিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশী সমাজের রাজনীতি ও নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোতে গভীর শেকড়ের সুবাদে ভারতীয় মিডিয়ায় এসব খবর প্রথম উদয় হচ্ছে, ঘটনাবলীকে আরো উদ্বেগজনক করে তুলছে।

প্রথম খবরটি প্রকাশিত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা সম্পর্কে, দ্বিতীয় খবরটি ছিলো প্রধান বিচারপতি সিনহার সরকার উৎখাত পরিকল্পনা সম্পর্কিত এবং তৃতীয়টি ছিলো কিছু কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠক নিয়ে। এর সবগুলোই একটি বিরক্তিকর প্রবণতার ইঙ্গিত। যদিও প্রতিটি খবর অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ সরকার। তবে এসব খবর শেখ হাসিনাকে বিচলিত করতে পারেনি।

বিচারপতি সিনহার অত্যন্ত অসম্মানজনক বিদায় আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ধূসর রেখাটি মনে করিয়ে দেয়। এটা রাষ্ট্রকাঠামোর দুর্বলতারই পরিচায়ক। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে সক্ষম কোনো শাসক মহলের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না।

তবে মিডিয়া কর্মীদের ওপর সরাসরি হামলা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়। ক্ষমতাসীন শ্রেণি যে সুবিবেচনা ও সহিষ্ণুতাকে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না এটি তার বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোকে যেভাবে উৎখাত করা হয়েছে এবং অন্তর্কোন্দল সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়েছে, এখন ওই আঘাত একেবারে সরাসরি ও ঘন ঘন মিডিয়ার গায়ে লাগছে। মিডিয়া মালিকদের প্রায় সবাই অনুগত। একটি স্টেশন দাঁড় করানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়, বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। তাই কোনো ধনকুবের সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো ততটা বোকা নন। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে সমস্যা হলো শুধু স্থানীয় মিডিয়াই তথ্যের উৎস নয়। তাই দর্শক আকৃষ্ট করতে মিডিয়াকে খবর প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিরপেক্ষ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া এখন এমন এক বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে যেখানে ভারতীয় মিডিয়ার উপস্থিতি প্রবল। সেন্সরশিপেরও সীমা আছে এখন।

এই সবগুলো কণ্টক গত তিন মাসে বাংলাদেশে এসে হাজির হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রবেশ শুরু করে, ষোড়শ সংশোধনী সংকট, বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিচারপতি সিনহার বিদায়, অভ্যুত্থান ও হত্যা প্রচেষ্টার বহুসংখ্যক খবর, রাজনৈতিক সহিংসতা ও মিডিয়া কর্মীদের ওপর হামলা। এই সবগুলো ঘটনাই ঘটেছে অত্যন্ত স্বল্পসময়ে মাত্র তিন মাসের মধ্যে। মানুষের মন আচ্ছন্ন করেছে ঢাকার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এই চরম অনিশ্চয়তা বা বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে একটি শক্তি ফায়দা হাসিল করতে চায় বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতিতে সবকিছু সম্ভব বলে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে কান না দেয়ার মানে হলো, প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়া সিস্টেমটি ওই বিন্দু পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

(তিন)
আওয়ামী বামরা নিরন্তনভাবে বাংলার জমিন থেকে ইসলামী আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ কাজে তারা সফল হবেনা। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে অগ্রসরমান আদর্শ ইসলাম। আদর্শ নিজেই একটি শক্তি। আজকের দুনিয়ায় এটি সর্বত্র ফ্যাক্টর হিসেবেই টিকে আছে। ইসলাম সারা দুনিয়ার সামনে আলোচিত এজেন্ডা। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ল’ স্কুলের প্রফেসর নোয়াহ ফেল্ডম্যান যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের নিয়মিত কলাম লেখক। এছাড়া তিনি মার্কিন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স নামক সংস্থার একজন সিনিয়র ফেলো। তিনি তাঁর ‘The Fall And Rise Of The Islamic State’ গ্রন্থটি লিখেছেন- “ইসলামী আন্দোলনের গতি সে সব দেশে তীব্রতর হচ্ছে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামী দলগুলো বেশ সক্রিয় থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

শাসক গোষ্ঠী নানা কৌশলে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, শক্তি প্রয়োগ এবং গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে যারা পরাস্ত করতে চাইছে, তারা অতি মাত্রায় স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা চর্চা করছে। এ বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, ইসলামপন্থীরা যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়, তাহলে জনগণ হয়ত তাদেরকেই ভোট দেবে। তবে তার জন্য তাদের যেমন নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক আন্দোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে হবে, তেমনি সমাজে উপস্থিত নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সকল শক্তির এ ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে”। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এখানেও ইসলামী আন্দোলন একটি উত্থিত শক্তির নাম। একটি পরিবর্তনের প্রতিধ্বানি।

সুতরাং দমন-নিপিড়ন আর হত্যা করে ইসলামকে রোখা যাবেনা। সমাজের তৃণমূলের শেকড় আর মানুষের হদয়ে ইসলামের প্রতি প্রচন্ড দরদ, ভালোবাসা জামায়াতের সবচেয়ে বড় পুঁজি। জামায়াতের জনপ্রিয়তা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিকট অতীতের স্থানীয় সরকার নির্বাচনই তার বড় প্রমাণ।

এখন গোটা পৃথিবী থেকে ইসলাম নির্মূলের যে নিঘুম প্রলয় শুরু হয়েছে তার সাথে বুঝে হোক অথবা না বুঝে হোক বর্তমান সরকার অংশীদার হয়ে পড়েছে। আধিপত্যবাদী শক্তির কথা পুরো শুনলে সরকার জনসর্মথন হারাবে না শুনলে ক্ষমতা হারাবে। এই উভয় সংকটের দোলাচলে এখন আওয়ামী লীগ। তাছাড়া দু’পরাশক্তিকে এক সাথে খুশি করাও দুরূহ।
সুতরাং বিভেদ রাজনীতিকে ভালো পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে না। তাই একমাত্র রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐক্যেই কেবল এ প্রলয় আর মহাদুর্যোগের ঘনঘটা থেকে দেশ-জাতিকে রক্ষা করতে পারে। সে শুভবুদ্ধি আওয়ামী-বামদের মধ্যে জাগবে- সবার এটাই কামনা।

http://www.dailysangram.com/post/307607