১৪ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৯

বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার অধরা সেই সিন্ডিকেট

সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস * নজরদারির দায়িত্ব সরকারের। কোনো ধরনের কারসাজি হলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে : ড. মির্জ্জা আজিজ

সরবরাহ স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক বাজারেও কমছে দাম। এরপরও দেশে বেসামাল হয়ে উঠেছে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও সবজি- এ পাঁচ নিত্যপণ্যের দাম। পুরনো সেই শক্তিশালী কারসাজি চক্রের (সিন্ডিকেট) সৃষ্ট কৃত্রিম সংকটের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য নেই তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে অধরাই থেকে যাচ্ছে ওই চক্রটি।

এসব পণ্য কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের নাগালে আসছে না। এমনকি কোনোটির মূল্য তিন মাসে দ্বিগুণ হয়েছে। ওই পাঁচ পণ্য ছাড়াও মাছ-মাংসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিন্মবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও আয়ের সব টাকা চলে যাচ্ছে খাওয়ার খরচে। তবে এর দায় নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কেউ। সব পক্ষই ভিন্ন ভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছে। সরকার বলছে, পণ্য সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। তবে দাম বেশি, তা মানতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিবিদরা বলেন, পণ্যের মূল্যের বিষয়টি নজরদারির দায়িত্ব সরকারের।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এটি স্বাভাবিক নয়। তার মতে, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে একজন আরেকজনের দোষ দেয়। তবে বিষয়টি নজরদারির দায়িত্ব সরকারের। তিনি আরও বলেন, কোনো ধরনের কারসাজি হলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরি সোমবার যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেলে ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণœ হয়। তাই ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দরকার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। কিন্তু দেশে সেটি হচ্ছে না। কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এরা কারসাজি করলে তখন সরকারের আর করার কিছু থাকে না। তিনি মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু তার মানে এ নয়, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তা-ই করার সুযোগ পাবে। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও থাকে। বাংলাদেশেও এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সুফল দেয়, তার জন্য টিসিবির সক্ষমতাও বাড়ানো জরুরি। নতুবা দেশের প্রেক্ষাপটে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা দুরূহ ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে।

জানা গেছে, এক বছর ধরেই দেশে পণ্যের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির রিপোর্টে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা আগের তিন মাসের চেয়ে দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। সংস্থাটি বলছে, চালের কারণেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কোরবানির ঈদের আগ থেকে হঠাৎ বাড়তে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যের দাম। ওই সময়ে এক লাফে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এরপরই বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে। পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে আটা, তেল, ডালের দাম। সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে কাঁচামরিচ ও পেঁয়াজের দাম।
জানতে চাইলে রাইস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জাকির হোসেন রনি যুগান্তরকে বলেন, মিলারদের কারণে চালের দাম বেড়েছে। ওই সময়ে তারা বেশ কিছু ধান-চাল মজুদ করেছেন। ফলে কৃত্রিম সংকট হওয়ায় দাম বেড়েছিল। তবে এখন কমতে শুরু করেছে দাম। বর্তমানে কোনো কোনো আমদানিকারক লোকসানও দিচ্ছেন। তারা ভারত থেকে ৪৩ টাকায় চাল এনে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, দাম আর বাড়বে না। কারণ আমনের মৌসুম শুরু হয়েছে। এ মৌসুমে প্রায় ২ কোটি টন চাল আসে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, পণ্য মূল্যের উঠা-নামা বাজারের ধর্ম। কিন্তু দাম যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে তখনই জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। তাই এটা দূর করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে চাহিদা নিরূপণ করে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। তারা একবার দাম বাড়ালে আর কমান না। তার মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো তেমনভাবে কার্যকর নেই।
জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। আর কোরবানির পর সেপ্টেম্বরে পুরোপুরি অস্থির ছিল চালের বাজার। সে সময় মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। যদিও কয়েক দফা আমদানির পর বর্তমানে দাম কিছুটা কমেছে। তবে এখনও তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। সোমবার স্বর্ণা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। এছাড়া নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও কমছে চালের দাম। বাংলাদেশ মূলত চারটি দেশ থেকে চাল আমদানি করে। সেগুলো হচ্ছে- ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া এবং মিয়ানমার। অক্টোবরে ভিয়েতনামে প্রতি টন চালের দাম ছিল ৩৭৬ ডলার। এ হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ে ২৯ টাকা। এক মাস আগেও যা ছিল ৩২ টাকা। এ হিসাবে কেজিতে দাম ২ টাকা কমেছে। শতকরা হিসাবে যা ৫ শতাংশের বেশি। সোমবার কলকাতাতে আইআর ৩৬ (বাংলাদেশে মোটা চাল হিসেবে পরিচিত) নামের চালের কেজি ছিল ২৭ রুপি। এ হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজির দাম পড়ে ৩২ টাকা। এক মাস আগেও দাম ছিল একই রকম।

জাতিসংঘের খাদ্য সম্পর্কিত সংস্থা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (ফাও) হিসাবে সামগ্রিকভাবে খাদ্যের দাম ১ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। সংস্থাটি ৫টি পণ্য ধরে খাদ্যমূল্যের সূচক করে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে ১ দশমিক ১ শতাংশ, দুগ্ধপণ্যের দাম কমেছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ, মাংসের দাম দশমিক ২ শতাংশ এবং চিনির দাম দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। তবে বাংলাদেশে এর কোনো প্রভাব নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে অস্থির হয়ে উঠেছে পেঁয়াজের বাজার। আগস্টে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ২ মাসের ব্যবধানে নভেম্বরে তা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এ সময়ে দেশি পেঁয়াজ ১০০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়। কারওয়ান বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. হোসাইন আলী যুগান্তরকে বলেন, কোরবানির ঈদ থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই। তিনি বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাজারে পেঁয়াজ সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই খুচরা বাজারেও বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়। কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবদুল মালিক যুগান্তরকে বলেন, বাজারে পুরান পেঁয়াজ শেষের দিকে। নতুন করে আবাদ করা পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। তাই বাজারে দেশি পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে- যার কারণে দাম একটু বাড়তির দিকে। তিনি বলেন, নতুন পেঁয়াজ এলেই দাম আবার কমবে।
চট্টগ্রামে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনও প্রভাব পড়েনি খুচরা বাজারে। গত দু’দিনে দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে কেজিতে পেঁয়াজের দাম কমেছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকায়। ক্যাবের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, এটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি সরকারের মনিটরিং না থাকায় খুচরা বাজারে দাম কমার প্রভাব পড়ছে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কিছুদিন পরপরই পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে নানা অজুহাতে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতে পারছেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অতি মুনাফা করতে না পারেন সে জন্য প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো যেতে পারে।’

এদিকে বাজারে আসতে শুরু করেছে শীতের সবজি। বৃষ্টি এবং বন্যার অজুহাতে কয়েক মাস ধরেই সবজির দামে চড়া ভাব দেখা যাচ্ছে। সরেজমিন সোমবার রাজধানীর পুরান ঢাকার নয়াবাজার, শান্তিনগর কাঁচা বাজার, মালিবাগ বাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রত্যেকটি সবজি উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে নতুন আলু প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। শিম মান ভেদে ও আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৯০ টাকা। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। গাজর ৯০ থেকে ১০০ টাকা। করলা ৫০ থেকে ৬০ টাকা। পটোল ৫০ টাকা। ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ঢেড়স প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। প্রতিটি লাউ আকার ভেদে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। বেগুন প্রতি কেজি ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। মাঝারি আকারের একেকটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। পালং শাক প্রতি আঁটি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। লাল শাকের আঁটি ৩০ টাকা। পুঁইশাক আঁটি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। ৩ মাস আগে এসব পণ্যের দাম প্রায় অর্ধেক ছিল। শান্তিনগর কাঁচা বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, শীতের শুরুতে ক্রেতাদের সবজির প্রতি চাহিদা বাড়ে। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ তেমন বাড়ছে না। তাই সবজির দাম এখন একটু চড়া। তিনি বলেন, বাজারে শীতের সবজি আসতে শুরু করেছে। তাই কয়েকদিনের মধ্যে দাম একটু কমবে।
রাজধানীর নয়াবাজারের তুহিন স্টোরের মালিক মো. এখলাস যুগান্তরকে বলেন, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা। আর বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেল ১১০ টাকা এবং ৫ লিটার ৫২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ভালো মানের মুসরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা। আর সাধারণ মুসরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এদিকে মাংসের দামে নাভিশ্বাস উঠছে ভোক্তাদের। ইচ্ছ থাকলেও সাধ্য না থাকায় অনেক নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে মাংস জুটছে না। রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা। খাসির মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা।
রাজধানীর শান্তিনগর কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা বেসরকারি কর্মকর্তা মো. জাহিদুল হাসান জুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম এত বেশি যে জীবন চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার বা চারবার ও গরুর মাংস খাওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে মাসে দু’বার খেতে হচ্ছে। সবজির বাজারেও কিছু করার নেই।

 

https://www.jugantor.com/online/economics/2017/11/14/63442