১৪ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৫

চলছেই প্রশ্ন ফাঁস

পরীক্ষার আগেই হাতে হাতে প্রশ্ন

জাতিকে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে -এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম : প্রশ্ন ফাঁস সংস্কৃতি হয়ে গেছে -সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারাবে ছাত্ররা -এমাজউদ্দীন আহমদ

প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষাতেই প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠছে। প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে কোন কোনটির। পরীক্ষা শুরুর আগেই পরীক্ষার্থীদের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি), মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী বাদ যাচ্ছে না কোনটিই। আর এতে সহযোগিতা করছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরাই। জীবনের শুরুতেই সন্তান ও শিক্ষার্থীদের এ অনৈতিক কাজে উৎসাহিত করে প্রকৃতপক্ষে জাতি হিসেবে তাদের পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা। প্রশ্নফাঁস যাতে বন্ধ করা যায় সেজন্য এবার থেকেই পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে প্রবেশের নতুন নিয়ম করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রশ্নফাঁস রোধে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কাজে আসছেনা কোনটিই। বরং পরীক্ষা শুরুর আগে ঠিকই প্রশ্ন পেয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তাই পরীক্ষায় পাসের জন্য এখন পরীক্ষার্থীরা বইয়ের পরিবর্তে মোবাইল ও ফেইসবুককেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। বৃথাও যাচ্ছেনা তাদের এই সময়। রাত ১২টা থেকে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই তারা পেয়ে যাচ্ছেন কাক্সিক্ষত প্রশ্নপত্র। যা দিয়ে অর্জিত হচ্ছে জিপিএ-৫ এর মতো সর্বোচ্চ রেজাল্টও।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোন ধরণের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা অননৈতিক, অনাকাক্সিক্ষত ও অগ্রহণযোগ্য। এ ধরণের ঘটনা ঘটলে পড়াশুনা করা ছাত্ররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, প্রশ্নফাঁস ও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে বাণিজ্য এখন দেশের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের সিংহভাগ বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে। পরীক্ষাগুলোও এখন বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে।

সচেতন অভিভাবক ও শিক্ষকরা অভিযোগ করে বলেন, এখন প্রতিদিনই ডিজিটাল উপায়ে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা বাদ দিয়ে পরীক্ষার আগে চোখ রাখছে মোবাইলের স্ক্রিনে। তারা বলেন, যে কোনো উপায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতেই হবে। না হলে এ জাতি জীবনেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। প্রশ্নফাঁস এখন ওপেন সিক্রেট ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের সহকারী কেন্দ্র সচিব জিনাত ফারহানা বলেন, আমরা শিক্ষকরাই প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী। বিভিন্ন স্কুলগুলো তাদের সুনাম ধরে রাখতে প্রশ্নফাঁসে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশ্ন তো শিক্ষকদের কাছেই আসে। তারা আগেভাগে প্রশ্ন খুলে তা ছড়িয়ে দেন। আর অভিভাবকরাও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সন্তানদের সাহায্য করছেন।

চলতি বছর জেএসসি পরীক্ষার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে প্রশ্নফাঁস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষক অভিভাবকদের সাথে নিয়ে প্রশ্নফাঁস করেছেন। যার কিছু চিত্রও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আনিস জামান পিপু তার মোবাইলে সেই প্রশ্নফাঁসের চিত্র তুলে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লেখেন, “ইন্টার-ডিপার্টমেন্ট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এবং নিজ ব্যাচের খেলা চলার সুবাদে, দর্শক হিসেবে ৯ নভেম্বর সকাল ৭ টায় ‘জাহাঙ্গীরনগর স্কুল ও কলেজ মাঠ প্রাঙ্গনে হাজির হই। খেলা সাড়ে ৮টায় গড়াতে না গড়াতেই শুরু হয় বিভিন্ন স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষার্থী বহনকারী বাসের আগমন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, একজন শিক্ষক ৩ জন ছাত্রীকে বাসগুলোর পেছনে নিয়ে যান! সন্দেহ হওয়াতে ছুটে যেয়ে দেখি, তিনি তার এন্ড্রয়েড ফোনটি বের করে, দেখে দেখে বলে দিচ্ছেন একের পর এক অবজেক্টিভ প্রশ্নের উত্তর! এভাবে তিনি একটু পর পর কয়েকজন করে পরীক্ষার্থীদের নিয়ে গিয়ে বলতে থাকেন সবগুলো উত্তর! তিনি শুধু একাই নন, অন্য বাসগুলো থেকেও কয়েকজন শিক্ষক একই কাজ করতে থাকেন! আমি আরও অবাক হলাম, যখন দেখতে পেলাম, কিছু অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের নিয়ে একইভাবে, ফোন দেখে উত্তর মুখস্ত করাতে থাকেন! হঠাৎ দেখলাম, প্রায় সকল শিক্ষার্থীর হাতে বইয়ের বদলে, এন্ড্রয়েড ফোন! শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নেয়ার বদলে, শিক্ষার্থীরা নকল বা চিটিং করায় ব্যস্ত ছিল’! কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজেই নয়, একই চিত্র রাজধানীর অন্যান্য স্কুলগুলোতেও দেখা যায়। গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে জেএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, পরীক্ষা শুরুর আগে শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কোথাও একা, আবার কোথাও দুই-তিনজন মিলে তারা প্রশ্নপত্র ও উত্তর দেখছেন। আর তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে সন্তানদের সহযোগিতা করছেন অভিভাবকরা। কোথা থেকে প্রশ্ন এসেছে জানতে চাইলে কয়েকজন শিক্ষার্থী উত্তর দেন পরিচিত ভাইয়া আছে, তার কাছ থেকেই প্রশ্ন পাই। এ প্রশ্ন পরীক্ষায় আসবে কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ভাইয়া শিওর হয়েই প্রশ্ন দেয়। পাশেই দাঁড়ানো এই জটলার আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক প্রশ্ন ফাঁসের কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা কেউই তো চাই না আমার বাচ্চাটা পরীক্ষায় খারাপ করুক। সবাই তো প্রশ্ন পাচ্ছে। যা পড়ার আগেই তো পড়ছে, কিন্তু এখন একটু চোখ বুলিয়ে যাওয়া। এর ফলে সন্তানের ‘নৈতিক অবক্ষয়’ হচ্ছে জেনেও এ অভিভাবক বলেন, ওর বন্ধুরা পাচ্ছে, সেখান থেকে ও দেখে নিচ্ছে। তবে অনেক অভিভাবক প্রশ্নফাঁসের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কোন মানে হয়না। বরং পরীক্ষার নামে জীবনের শুরুর দিকেই ছেলে-মেয়েদের অনৈতিক পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

জানা যায়, প্রতিটি পরীক্ষার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ওই বিষয়ে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফেইসবুকের বিভিন্ন পেইজ থেকে কোন কোনটায় টাকার বিনিময়ে আবার কোনটাতে বিনামূল্যেই প্রশ্নপত্র দেয়া হয়। এসব প্রশ্নের সাথে হুবহু মিলে যায় পরীক্ষায় আসা প্রশ্নপত্র। অনেকটা ঘোষণা দিয়েই এবং প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হচ্ছে এসব গ্রুপে। ‘সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সমাহার’, পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি প্রশ্ন সাজেশন, জেএসসি কোশ্চেন পেপার ২০১৭, জেএসসি কোশ্চেন আউট ২০১৭ অল বোর্ড, অল এক্সাম কোশ্চেন রকি ভাই, জেএসসি এক্সাম কোশ্চেন ২০১৭ এরকম অসংখ্য নামে পেইজ খুলে সেগুলোতে পরীক্ষার আগের রাত থেকেই নিশ্চিত প্রশ্ন দেয়ার কথা বলা হয়। এমনকি কখন দেয়া হবে তাও উল্লেখ থাকে। প্রমাণ হিসেবে আগের পরীক্ষার প্রশ্ন কয়টার সময় দেয়া হয়েছিল তাও তুলে দেয়া হয়। শাহীন হাসান নামে একজন অভিভাবক বলেন, ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে মোবাইল নম্বর দিয়ে টাকা পাঠিয়ে প্রশ্নের জন্য যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। এখন তো সব সিম বায়োমেট্রিক করা, তাহলে এরা কারা? এদের বের করা কি কঠিন? নাকি বড় রাঘববোয়ালরাই প্রশ্ন ফাঁস করছে? আরেক অভিভাবক নাসরীন নাহার বলেন, কয়টা প্রশ্ন কোন কেন্দ্রে যাচ্ছে সেটা হিসাব করে তৈরি হওয়ার কথা। তাহলে উপরের লোকজন জড়িত না থাকলে উত্তরে টিক চিহ্ন দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব হয় কীভাবে?
ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পাস করে দেশ কেমন জাতি পাবে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করলেও নিজেরাই জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই অনৈতিক কাজের মাধ্যমে বিনা বিদ্যা-বিনা জ্ঞান অর্জনে তারা নম্বর পেয়ে যখন উচ্চ আসনে বসবে তারাও অনৈতিক কাজকে প্রশ্রয় দিবে। আর এর মাধ্যমে পুরো জাতিকে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। প্রশ্নফাঁসের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার আসার পর থেকেই প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছে। এমন কোন পরীক্ষা বাদ যাচ্ছেনা যেটাতে শুনিনি প্রশ্নফাঁস হয়নি।

প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সন্তানদের সৎ মানুষ হিসেবে গড়তে শিক্ষক-অভিভাবককে সৎ হতে হবে। যেসব স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনে আওতায় আনা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিবাজ কিছু শিক্ষকের হাত ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে এবং যে অভিভাবক টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন কিনছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলেও মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী।

 

 

https://www.dailyinqilab.com/article/104238