১৪ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২২

আরাকানে ফের রোহিঙ্গা নিপীড়ন : ভেলায় ভেলায় আসছেন রোহিঙ্গারা

কুতুুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন দেড় হাজার

আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ওপর ফের নির্যাতন শুরু করেছে সরকারি বাহিনী ও তাদের দোসররা। ফলে সীমান্তের নাফ নদী পার হয়ে আবারো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা। সাঁতার কেটে, ভেলায় করে, যে যেমনি পারছেন নাফ নদী পার হয়ে প্রবেশ করছেন বাংলাদেশে। নৌকা সঙ্কটের কারণে প্লাস্টিকের জেরিকেন, কাঠ, বাঁশ ও দড়ি দিয়ে ভেলা তৈরি করে ঝুুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আসছেন তারা। দক্ষিণ আরাকানে ধাওনখালী চরে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা উভয় সীমান্তে নৌকা সঙ্কটসহ নানা বাধার মুখেও অভিনব কৌশলে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গতকাল দিনে ভেলায় ভেসে ও রাতে নৌকায় চেপে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সহস্র্রাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছেন।
আজ সোমবার সকালে নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ ও সাবরাং পয়েন্ট দিয়ে দু’টি ভেলায় শতাধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন। এদের ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছে।
উখিয়ার আনজুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢোকা ১৫ শতাধিক রোহিঙ্গাকে বালুখালী ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছে। আনজুমানপাড়া সীমান্তের নাফ নদীর ওপারে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন দুই হাজারের অধিক রোহিঙ্গা। গতকাল বিকেল ৫টায় নাফ নদীর এপারে সাবরাং নোয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আটটি ভেলায় করে ৩৪৬ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছেন। এদের মধ্যে ১৯৯টি শিশু, ১১৯ জন নারী ও ৭৮ জন পুরুষ রয়েছেন। এদের মানবিক সহায়তা দিয়ে বিজিবি নোয়াপাড়া বিওপির হেফাজতে রাখা হয়েছে।

বিজিবি সূত্র জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন নির্দেশে এসব রোহিঙ্গার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভেলায় ভেসে আসা আরকানের বুচিডং এলাকার রোহিঙ্গা নারী আমিনা খাতুন বলেন, ‘মিয়ানমার সেনারা আমার নিজের বাড়ি ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, গ্রামের অনেক পুরুষকে তারা অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে, এখন তারা আমাদের স্বাভাবিক চলাচল করতে দিচ্ছিল না, তাই আমরা রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিতে ১৫ দিনে আগেই ধাওনখালী সীমান্তে এসে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সেখানে এসে কোনো নৌকাও মিলছিল না বাংলাদেশে আসতে। তাই বাধ্য হয়ে ভেলায় ভেসে ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে এপারে চলে এসেছি।’
রোহিঙ্গা যুবক আলী আহমদ বলেন, ‘ওপারের সেনারা আমাদের মতো যুবকদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, যাদের নিয়ে গিয়েছিল আমরা তাদের কারো খোঁজ পাইনি। এ ছাড়া সেনা ও মগরা আমাদের ক্ষেতের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোথাও বেরুতে দিচ্ছিল না। চিকিৎসা কিংবা দরকারি কাজেও ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। তাই সেখানে আমাদের খুব অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তত জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না।’
ওই যুবক আরো বলেন, ‘আমরা ধাওনখালী চর থেকে ভোরেই ভেলায় উঠছিলাম। কিন্তু ভাটার কারণে আমাদের ভেলাটি সামনের দিকে এগোচ্ছিল না। পরে জোয়ারের সময় আমরা এপারে পৌঁছেছি। আমাদের সাথে থাকা শিশু ও মায়েরা ভয়ে খুব কান্নাকাটি করছিল। এপারে এসেই আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি।’
ভেলায় আসা রোহিঙ্গারা আরো জানিয়েছেন, ওপারের ধাওনখালী চরে এখনো হাজার দশেক রোহিঙ্গা এপারে পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু তারা সেখান থেকে আসতে কোনো নৌকা পাচ্ছেন না। দু-একটি নৌকা ওপারে ভিড়লেও নৌকার মাঝিরা রোহিঙ্গাদের এপারে নিয়ে আসতে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করছেন। নৌকা সঙ্কটে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে সব রোহিঙ্গাদের নৌকায় চেপে বাংলাদেশে ঢোকা সম্ভব হয়নি। তাই তারা নিজেদের উদ্যোগে জেরিকেন ও বাঁশ দিয়ে ভেলা বানিয়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন বলে জানান।
উল্লেখ্য, এ নিয়ে গত ৮ নভেম্বর থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৩টি ভেলায় নারী শিশুসহ এক হাজার ১৩৩ রোহিঙ্গা নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। এর আগে গত ১১ অক্টোবর থেকে সাত দফায় ৬১ জন রোহিঙ্গা নাফ নদী সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন। তবে সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে আসতে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা অক্ষম হওয়ায় মূলত তারা ভেলা বানিয়ে এপারে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানায়।

এদিকে ভেলায় আসা রোহিঙ্গারা ছাড়াও নৌকায় নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ মাঝের পাড়া সৈকত, হারিয়াখালী সৈকত, শামলাপুর সৈকত, নাফ নদের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়া, নোয়া পাড়া পয়েন্টসহ উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত দিয়ে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এ হিসেবে গতকাল এক দিনেই উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ভেলায় ও নৌকায় করে সহস্র্রাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেন।
কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন এক হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের বুচিডং, রাচিডং, কোয়াংডংসহ ১২টি গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা গত রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ঢুকে পড়েন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকতে সক্ষম হলেও এখনো তাদের আশ্রয় মেলেনি। তবে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এসব রোহিঙ্গাকে খাদ্য, চিকিৎসাসহ যাবতীয় মানবিক সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
জানা গেছে, আরাকান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা গত বুধবার রাতে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের দেয়া কাঁটাতারের বেড়াসংলগ্ন মেদি এলাকায় খোলা আকাশের নিচে জড়ো হয়ে অবস্থান করছিলেন। অভুক্ত এসব রোহিঙ্গা খাদ্য, ওষুধ ও থাকার জায়গা না পাওয়ায় অনেককেই অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখা গেছে। এপারে বিজিবির কড়া প্রহরা উপেক্ষা করে রোহিঙ্গারা ভেতরে ঢুকতে না পারায় সেখানে তাদের দুই দিন দুই রাত অবস্থান করতে হয়েছে।

শুক্রবার রাতে জড়ো হওয়া এসব রোহিঙ্গা জীবন বাজি রেখে নাফ নদী সাঁতরিয়ে আঞ্জুমানপাড়ার শূন্য রেখায় আশ্রয় নেয় বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ইউপি সদস্য সুলতান আহমদ নিশ্চিত করেছে। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ওই রোহিঙ্গাদের ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদী পার হওয়ার ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে স্থানীয় বিজিবির সদস্যরা তাদের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসেন। রোহিঙ্গারা যাতে শূন্য রেখা থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে না পারে সে জন্য শনিবার ও রোববার সারা দিন রোহিঙ্গাদের বেড়িবাঁধের ওপর রেখেছে বিজিবির সদস্যরা। এ সময় রোহিঙ্গারা চিংড়ি ঘেরে ও নাফ নদীসংলগ্ন বেড়িবাঁধের আনাচে-কানাচে শুকনা জায়গায় আশ্রয় নিয়ে দিন-রাত কাটিয়েছেন। বিভিন্ন এনজিও আশ্রিত এসব রোহিঙ্গাকে ওষুধ, খাদ্য ও মানবিক সেবা দিয়ে সহযোগিতা করলেও বেশির ভাগ বয়োবৃদ্ধ ও শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে বিজিবির সদস্যরা জানিয়েছেন।
উখিয়া টিভি রিলে কেন্দ্রের পাশে রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে হেঁটে হেঁটে কথা হয় আঞ্জুমানপাড়া শূন্য রেখায় আশ্রয়ের জন্য ছুটে চলা মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার কোয়াংডং গ্রামের মো: রফিকের (৩৪) সাথে। তিনি জানান, মিয়ানমারে চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার কারণে ছেলেমেয়ে স্ত্রীসহ পাঁচজন নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তার চার একর জমির পাকা ধান মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন উগ্রবাদীরা কেটে নিয়ে গেছে। বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। যার কারণে জীবন বাঁচাতে দুই দিন কাটা তারের বেড়ার পাশে অবস্থান করে মিয়ানমারের ওপারে চলে এসেছেন। তার মতো একই কথা অন্য রোহিঙ্গাদেরও।

পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের বেড়িবাঁধের ওপর অবস্থান নেয়া হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু গত রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে কিছু এনজিওর লোকজনের কড়া প্রহরায় কুতুপালং ক্যাম্পে দিকে চলে আসতে দেখেছি।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান সহস্রাধিক রোহিঙ্গার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার নির্ধারিত জমিতে আবাসন তৈরি করে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন।
এ দিকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে চার লাখ ৯৮ হাজার ১৩৪ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক ৩৬ হাজার ৩৭৩ জন এতিম শিশু শনাক্ত করা হয়েছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) রিপোর্ট মতে ২৫ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত ছয় লাখ ২৭ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/268232