১৪ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৮

আসিয়ান সম্মেলনের খসড়া বিবৃতিতে ‘রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ বাদ’

অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স (আসিয়ান) সম্মেলনের শেষে যে বিবৃতি দেওয়া হবে তাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়নের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হচ্ছে না বলে খবর বেরিয়েছে।
গত সোমবার বিবৃতির ঘোষণাপত্রের একটি অনুচ্ছেদ দেখার পর বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ওই অনুচ্ছেদে ভিয়েতনামে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক ত্রাণ পাঠানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ ও ইসলামী জঙ্গিদের সঙ্গে ফিলিপিন্সের সাম্প্রতিক লড়াইয়ের বিষয়টি উল্লেখের পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের ‘ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলোর’ কথা বলা হয়েছে।
আসিয়ান এর বর্তমান চেয়ারম্যান রডরিগো দুতার্তের দেশ ফিলিপিন্স খসড়া বিবৃতিটি তৈরি করেছে। মিয়ানমারও ১০ সদস্যের এই জোটের সদস্য রাষ্ট্র।

গতকাল সোমবার ম্যানিলায় আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর নেতারা এক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে মিলিত হয়েছেন।
খসড়া বিবৃতিটিতে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি এবং ‘রোহিঙ্গা’ নামটিও ব্যবহার করা হয়নি।
এই নামটি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিদেশি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সাং সু চি।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের সরকার দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম বাসিন্দাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের ‘ রোহিঙ্গা’ পরিচয় স্বীকার করে না।
২৫ অগাস্ট রাখাইনে কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এই অভিযান শুরুর পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়ে আছে।

রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশায় বিশ্বব্যাপী ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। মিয়ানামার সামরিক বাহিনীর নির্মূল অভিযানের নিন্দা না জানানোয় ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সু চি-র সমালোচনার পাশাপাশি তাকে দেওয়া নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিও উঠেছে।
রাখাইনে জাতিগত নির্মূল অভিযান চলছে বলে সেপ্টেম্বরে মন্তব্য করেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
আসিয়ানের কয়েকটি সদস্য দেশ, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়েশিয়া, রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগও জানিয়েছিল।
কিন্তু আসিয়ানের ‘এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ না করার’ নীতি মেনে সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুটি একপাশে সরিয়ে রাখা হচ্ছে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা।
সেপ্টেম্বরে আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের পক্ষ থেকে ফিলিপিন্সের ইস্যু করা একটি বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ না করায় ‘বাস্তবতার’ মিথ্যা বর্ণনার অভিযোগ তুলে ওই বিবৃতিতে আপত্তি করেছিল মালয়েশিয়া।

গত রোববার ম্যানিলায় দেওয়া ভাষণে সু চি নিজেও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো কথা বলেননি। অথচ ১৯৯৯ সালে থাইল্যান্ডের দৈনিক দ্য নেশনে প্রকাশিত নিজের এক কলামে আসিয়ানের ‘হস্তক্ষেপ না করার’ নীতির সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
তখন সামরিক জান্তা শাসিত মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করা সু চি লিখেছিলেন, “হস্তক্ষেপ না করার এই নীতি সাহায্য না করার একটি অজুহাত মাত্র। বর্তমান সময়ে অন্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা কেউ এড়াতে পারে না।”
আসিয়ানের শীর্ষ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনো আলোচনা হবে না বলে মনে করছেন ফিলিপিন্সের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্তো রোমুলোও।
ফিলিপিনো নিউজ চ্যানেল এএনসিকে তিনি বলেছেন, “অং সাং সু চির মতো নন্দিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীকে তারা খুব সম্মান দেখাচ্ছে।”
রাখাইনে যৌন সহিংসতার কথা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তোলা হচ্ছে
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে প্রধানত-মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সামরিক বাহিনীর চালানো যৌন সহিংসতা ঘটনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে অবহিত করবেন জাতিসংঘের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমীলা প্যাটেন অভিযোগ করেছেন, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী একটি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে একটি পরিকল্পিত ত্রাস ছড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। খবর বিবিসির।
তিনি আরো বলেন, এর লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের শরণার্ধী শিবিরগুলোতে সফর করে বিভিন্ন বয়েসের নারীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রমীলা প্যাটেন।
এর পর তিনি বলেন, গণহত্যার সময় ধর্ষণকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়াটাই সমাধান: মার্কিন মন্ত্রী সাইমন হেনশ
এর আগে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করার পর মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়াই হবে এই সঙ্কটের সর্বোত্তম সমাধান এবং মায়ানমারের সরকারকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে।
শনিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সফররত মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতা ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন হেনশ বলেন, মার্কিন প্রশাসনের সবোর্চ্চ স্তরে এখন রোহিঙ্গা ইস্যুটি গুরুত্ব পাচ্ছে।
অন্যদিকে মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের অবসান ঘটাতে দেশটির সামরিক বাহিনীর ওপর আরো কঠোর অবরোধ আরোপের একটি প্রস্তাব এনেছেন আমেরিকার ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান ও বিরোধী ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটরদের একটি গ্রুপ। সেই সাথে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে রাখাইন রাজ্যে ফেরার জন্য সামরিক বাহিনীকে সুষ্ঠু পরিবেশে নিশ্চিত করতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে মার্কিন একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফর শেষ করে বাংলাদেশের কক্সবাজারে গিয়েছিল সেখানে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে। এই মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতা মার্কিন জনসংখ্যা-শরণার্থী ও অভিবাসন ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন হেনশ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে শনিবার বলেন, যে পরিস্থিতি তিনি দেখেছেন তা ‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক’।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে মিয়ানমারকেই। হেনশ বলেন, সর্বপ্রথম এটা তাদের দায়িত্ব রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দ্বিতীয়ত নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা ও খবরের তদন্ত করা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা তাদের দায়িত্ব, তৃতীয়ত, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের অবশ্যই তাদের বাসস্থান ও জমিতে ফিরতে দিতে হবে। এজন্য দ্রুত তাদের বাড়ি ও গ্রাম পুনর্গঠনের ব্যবস্থা নিতে হবে । সর্বশেষ যেটি গুরুত্বপূর্ণ - রোহিঙ্গাদের সফলভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন।

ঢাকায় আমেরিকান ক্লাবে মার্কিন সহকারী মন্ত্রী এই বক্তব্য দিলেন এমন এক সময় যখন আমেরিকার কংগ্রেসে আরো কঠোর অবরোধের দাবি তুলেছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান এবং বিরোধী ডেমোক্রেট দলের সদস্যদের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য মিয়ানমার সরকারের সাথে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়ার জন্য বিল উপস্থাপন করা হয় শুক্রবার। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এটাকেই এ যাবৎকালের সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।
এই বিলে মিয়ানমারের ওপর আমদানি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নবায়নের দাবি তোলা হয়। ওই প্রস্তাবের পর বিবৃতিতে বলা হয়, বার্মায় নিরপরাধ শিশু নারী ও পুরুষকে হত্যা এবং ভূমিহীন করার জন্য দায়ী সামরিক কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে এবং এধরনের অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই তাদের পাশে দাঁড়াবে না।
এদিকে মায়ানমারে রাখাইনে নির্যাতন ও হত্যা প্রশ্নে ঢাকায় মার্কিন সহকারী মন্ত্রীও এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।

সাইমন হেনশ বলেন, আমরা নিয়মিতভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং কংগ্রেস আমাদেরকে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করেছে। ভয়াবহ নির্যাতনের বিভিন্ন ধরনের খবর রয়েছে এবং সেসব রিপোর্টের পূর্ণ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছি। যারা এজন্য দোষী বলে চিহ্নিত হবে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে।
মার্কিন কংগ্রেসে মায়ানমারের ওপর কঠোর অবরোধ বিষয়ে সর্বশেষ বিলটি আনা হলো এমন এক সময় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘ এক এশিয়া সফরের উদ্দেশ্য দেশ ছেড়েছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান, মার্কিন পররাষ্ট্রদপ্তরের মুখপাত্র হিদার নুয়ার্ট। মিয়ানমারে নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর গত ২৫ আগস্টের পর থেকে মাত্র দুইমাসে ৬ লাখের বেশি মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
তাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কি ধরনের ভূমিকা নিতে পারে- সেই প্রশ্ন করেছিলাম মিস্টার হেনশ’কে। তিনি জবাবে বলেন, ‘এক্ষেত্রে ‘চাপ’ শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হবে কিনা আমি নিশ্চিত নই । আমরা সবসময় তাদের উৎসাহিত করছি যত দ্রুত সম্ভব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যাতে স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা ফিরতে পারে। সেজন্য আমরা কূটনৈতিক এবং অন্যান্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দায়িত্ব মিয়ানমারের। তাদেরকে নিরাপদ এলাকা নিশ্চিত করতে হবে।’

মন্ত্রী হেনশ বলেন, ‘এই সমস্যার শুরু মিয়ানমারে সেখানেই এর সমাধান। আর প্রত্যাবাসন প্রকিয়ার দায়িত্ব নিতে হবে মিয়ানমারকে।’ মিয়ানমার সফরকালে মার্কিন প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে সংবাদ মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রবেশাধিকার চাওয়া হয়েছে।
তবে মার্কিন কতৃপক্ষ বারবারই মায়ানমারের সামরিক সরকারের উদ্দেশ্যে তাদের কঠোর বক্তব্য উল্লেখ করলেও সরাসরি অং সান সুচির সরকারকে দোষারোপ করছেনা।
অন্যদিকে মার্কিন সিনেটরদের প্রস্তাবের মাধ্যমে মায়ানমারের সামরিক এবং বেসামরিক সরকারকে সুনির্দিষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন কংগ্রেস সদস্যরা। যেখানে তারা বলেছেন, সংঘাত বন্ধ করতে হবে, অপরাধীদের জবাবদিহি করতে হবে এবং সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেসামরিক সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/307554