১৪ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৭

উন্নয়ন মহাসড়কের শেষ স্টপেজটি কতদূর?

দেশ এখন ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’- এমন কথা প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু মহাসড়ক ছাড়াও আরও অনেক ধরনের সড়ক আছে। সেসবের মধ্যে রয়েছে সংযোগ সড়ক, ফিডার রোড এবং গ্রামীণ সড়ক। এসব সড়কের অবস্থা কী? এগুলোকে কি মহাসড়কের সঙ্গে তুলনা করা যায়? একটি দেশের যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থায় সব ধরনের সড়কই ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের দেশে যে সড়কগুলোকে মহাসড়ক বলে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলোকেও প্রকৃত প্রস্তাবে উন্নত দেশের মহাসড়কের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তবুও আমরা এগুলোকে মহাসড়ক নামাঙ্কিত করে পরম তৃপ্ত অনুভব করি। মহাসড়কগুলোর অবস্থা যে ভালো নয় তা তো বোঝা যায় ঈদ উৎসবের মতো বড় বড় উৎসবে মানুষ যখন রাজধানী থেকে নিজ গ্রামমুখী হয়। যানজট, খানাখন্দ এবং প্রয়োজনীয় ফেরির অভাব মানুষের উৎসবযাত্রাকে দুর্ভোগে পরিণত করে। তারপরও নাড়ির টানে মানুষ মফস্বল বা গ্রামমুখী হয়। একরাত কিংবা দু’রাত স্বজনদের সঙ্গে কাটাতে পারলে যাতায়াতের দুর্ভোগ, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য, পথের ক্লান্তি ও ক্লেশ প্রশমিত হয়। সুতরাং যখন উন্নয়নের মহাসড়কের আপ্তবাক্য উচ্চারিত হয় তখন এসব কথা যারা বলেন, তারা কি এই মহাসড়ককে বাংলাদেশের মহাসড়ক বলে ভাবেন, নাকি উন্নত দেশের মহাসড়কের কথা ভেবে একথা বলেন। আমাদের সমস্যা হল আমরা যখনই যে কোনো অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করি, তখন সর্বোৎকৃষ্ট অথবা সর্বনিকৃষ্ট বিশেষণমূলক শব্দ বা শব্দবন্ধ উচ্চারণ করি। এ অভ্যাস থেকে মুক্ত না হতে পারলে আমরা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করব। ফলে উন্নত বা প্রাগ্রসর, বাস্তবতা উপলব্ধিতে আমরা ব্যর্থ হব। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উচ্চাশা বা আত্ম-প্রত্যয় থাকা দোষণীয় কিছু নয়। কিন্তু যখন এ উচ্চাশা ও আত্ম-প্রত্যয় ভ্রান্তিবিলাসে পরিণত হয়, তখন ব্যাপারটা দাঁড়ায় আত্মপ্রবঞ্চনা। সুতরাং উন্নয়ন সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আমাদের বাস্তব অবস্থা থেকেই সত্যানুসন্ধান করতে হবে।

একসময় ভাবা হতো উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি সমার্থক। কিন্তু যখন দেখা গেল প্রবৃদ্ধির সুফল বেশির ভাগ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে না, তখন বণ্টনের প্রশ্নটি সামনে এলো। উন্নয়নের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে কিনা, বেকারত্ব কমছে কিনা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, খাদ্যের পুষ্টিমান বাড়ছে কিনা, গড় আয়ু বাড়ছে কিনা, নিরক্ষরতার হার কমছে কিনা এমনসব বিষয় উন্নয়নের মানদণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হল। এছাড়া মানুষ সুখী ও মর্যাদাবান জীবনযাপন করতে চায়। মানুষ দেখতে চায় রাষ্ট্রের কাণ্ডারিরা তাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের এসব আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাক। মানুষ নির্ভয়ে তার মতামত ব্যক্ত করতে পারছে কিনা সেটাও উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত। একথা সত্য, আধুনিক জীবন মানেই জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়া। জটিলতার মধ্যে পড়ে মানুষ নানা রকমের অশান্তি, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ নানা ধরনের মনোদৈহিক রোগের শিকার হয়। এসব রোগকে উন্নয়ন দার্শনিকরা সভ্যতার রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এখন মানুষ কলেরা, বসন্ত ও প্লেগের মতো মহামারী থেকে মুক্ত হয়েছে বটে; কিন্তু অধিকতর হারে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও মনোবৈকল্যের শিকার হচ্ছে। এসব রোগব্যাধি মানুষের জীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করছে। তাই উন্নয়নের কথা ভাবতে হলে উন্নয়নসংশ্লিষ্ট রোগ ব্যাধিগুলোর কথাও ভাবতে হবে। জীবনের বস্তুগত মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর গুণগত মান কিভাবে বাড়ানো যায়, সে চিন্তাও করতে হবে। নিছক নিরক্ষরতা দূরীকরণ উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন এমন শিক্ষার বিস্তার, যা একদিকে আলোকিত মানুষ তৈরি করবে, অন্যদিকে তাদের দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ ঘটাবে। উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র চাই। কিন্তু সেই গণতন্ত্রের স্বরূপটি কেমন। সত্যিকার অর্থে সেই গণতন্ত্রই কাম্য, যে গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় শাসনের তুলনায় আত্মশাসন প্রাধান্য বিস্তার করে। সেখানে মানুষ রাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি রকমের চাপমুক্ত হয়ে নিজ বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতে ক্ষমতায়িত হবে। যে উন্নয়ন প্রাণবৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে, সে উন্নয়ন কাম্য হতে পারে না। প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতিকে নিয়ে যথেচ্ছাচারের ফলে প্রকৃতি যখন বিপন্ন হয়ে ওঠে, তখন মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। তেমন উন্নয়নও কাম্য হতে পারে না। সুতরাং উন্নয়নের গতি হবে পরিবেশ ও প্রতিবেশমুখী। এ আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে উন্নয়ন একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। যে উন্নয়ন মানুষে মানুষে উৎকট বৈষম্যের সৃষ্টি করে সে উন্নয়ন কখনই টেকসই হতে পারে না। এ ধরনের উন্নয়নের ফলে গণতন্ত্রও বিধ্বস্ত হয়। ইতিহাসের বিকাশের ধারা জানিয়ে দেয় উন্নয়ন সর্বত্রগামী এবং সমরূপী হয় না। গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। মানসিক শ্রম ও কায়িক শ্রমের মধ্যেও পার্থক্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভারসাম্যমূলক উন্নয়নে এ পার্থক্যগুলো যথাসম্ভব কমিয়ে আনার সুচিন্তিত ও সুদৃঢ় প্রয়াস থাকে।

বাংলাদেশের উন্নয়নে বহুমাত্রিকতার ছাপ খুব একটা স্পষ্ট নয়। গড় হিসেবে এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে বটে; কিন্তু এর পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে। সমাজের প্রান্তিক মানুষগুলো অধিকারবঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। এখানে সাঁওতালদের মতো প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর ঘর-বাড়ি শক্তিধররা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলেও এর কোনো বিহিত করা হয় না। অন্যদিকে সচ্ছল ও বিত্তবানরাও যে খুব সুখে আছে, তাও বলা যাবে না। তারা প্রায়শই ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণবাজির সম্মুখীন হয়। বিত্তহীনরা অর্থাভাবে ন্যায়বিচার পায় না। অন্যদিকে বিত্তশালীরাও যদি ভিন্নমতাবলম্বী হয় তারাও আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।

বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণ। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের স্বরূপ ও গভীরতা নিরূপণের জন্য একটি জরিপ চালিয়ে থাকে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এটিকে বলা হয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ। এ জরিপের মধ্যে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। তবে এ জরিপ মোটা দাগে আমাদের বুঝতে সাহায্য করে দারিদ্র্য নিরসনে আমরা কতটুকু এবং কী করতে পেরেছি। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, সার্বিকভাবে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের ১৮.২ শতাংশ কৃষি, বন ও মৎস্য চাষ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ পরিসংখ্যান নিন্মতর দারিদ্র্যসীমার বিবেচনায়। আর উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষ হিসাব করলে কৃষিজীবী আরও বেশি, ৩২ শতাংশ। পেশাগত বিবেচনায় দারিদ্র্যের প্রকোপ কৃষিতে সর্বোচ্চ। কৃষিতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি হবে এমনটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের কথা। কারণ কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সহজসাধ্য নয়। কিন্তু ভিন্ন এক বিবেচনায় বলতে হয়, যারা আমাদের মুখের গ্রাস জোগায় তারা থাকে অনেকটাই অভুক্ত। বাংলাদেশ-উত্তরকালে সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে।

কৃষি খাতও কিছুটা বহুমুখী হয়েছে। তদসত্ত্বেও এ খাতে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য এ উন্নয়ন যথেষ্ট নয়। সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিতে বাজার থেকে কেনা উপকরণের প্রয়োজনীয়তা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এর পাশাপাশি বেড়েছে এসব উপকরণের দাম। ফলে কৃষির উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। উপকরণ ব্যয় পুষিয়ে নেয়ার জন্য অর্থনীতির হাতিয়ার হল উপকরণ ভর্তুকি। কিন্তু কৃষি উপকরণের জন্য সরকারি ভর্তুকি অপ্রতুল হওয়ায় কৃষকদের পক্ষে উৎপাদন ব্যয় পুষিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের সিংহভাগই ক্ষুদ্র কৃষক। দেশের মোট কৃষকের ৭৫ শতাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র। এরা শুধু জোতের আকার ভিত্তিতেই ক্ষুদ্র নয়, ক্ষমতার দিক থেকেও অসহায়। মোট কৃষকের মাত্র ৮ শতাংশ বড় কৃষক ও ১৫ শতাংশ মাঝারি। গ্রামীণ সমাজে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের তুলনায় এরা অনেক বেশি প্রতাপশালী। ক্ষমতার জোরে যৎসামান্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি এরা হস্তগত করতে সক্ষম। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের আরও একটি বড় দুর্বলতা হল এরা প্রাতিষ্ঠানিক সূত্র থেকে খুব একটা ঋণ পায় না। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়ার জন্য যেসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে, সেগুলোও তারা অতিক্রম করতে পারে না। এছাড়া প্রয়োজনের সময় প্রাতিষ্ঠানিক সূত্র থেকে ঋণ পাওয়ার অনিশ্চয়তাও রয়েছে। সময়মতো যদি ঋণ না পাওয়া যায়, তাহলে সেই ঋণে তেমন কোনো কাজ হয় না। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণলভ্যতার সহজীকরণ এবং সময়ানুবর্তীকরণ করতে হবে অবশ্যই।

প্রাতিষ্ঠানিক সূত্র থেকে ঋণ জোগাড় করতে না পেরে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা মহাজন ও ফড়িয়াদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অথবা মাঠে শস্য কাঁচা থাকা অবস্থাতেই এর সিংহভাগ বিক্রি করে দিতে হয়। এ সময় শস্যের দাম থাকে খুব কম। অর্থনীতিবিদরা এ অবস্থাকে বলেন, অনিচ্ছুকভাবে বাজারে অংশগ্রহণ। অথচ সুষ্ঠু বাজার অর্থনীতির অন্যতম শর্ত হল বেচা-বিক্রি হবে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদফতরের হিসাব বলছে, পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে শস্যের গড় দাম কমেছে। ২০১০ সালে প্রতি টন শস্যের গড় দাম ছিল ১৯ হাজার ১৯১ টাকা। ২০১৪ সালে তা নেমে আসে ১৭ হাজার ৫শ’ টাকায়। মধ্যবর্তী ২০১১ সালে ১৯ হাজার ৬১০ টাকা, ২০১২ সালে ১৭ হাজার ১৬৬ ও ২০১৩ সালে ১৭ হাজার ৭১০ টাকা ছিল প্রতি টন শস্যের গড় দাম। যদিও এ সময় কৃষকের শস্য উৎপাদন খরচ ক্রমাগত বেড়েছে। এর পাশাপাশি যদি মূল্যস্ফীতি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে নিট অর্থে কৃষক আরও কম দাম পেয়েছে। ছয় বছরের ব্যবধানে কৃষি প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ১ শতাংশে নেমে এসেছে। কৃষি হল আমাদের মতো দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কিন্তু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ ভিত্তিটাই দুর্বল হয়ে যায়।

আশির দশকে নিজস্ব গবেষণায় দেখেছি, কৃষি আয়ের সঙ্গে কৃষিবহির্ভূত আয়ের সহসম্পর্ক ঋণাত্মক। অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক আয় কম হলে কৃষিবহির্ভূত আয় দিয়ে এ পরিস্থিতি মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। এরও ১৫ বছর পরের গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষি আয় ও কৃষিবহির্ভূত আয়ের সহসম্পর্ক ঋণাত্মক না হয়ে ধ্বনাত্মক হয়ে গেছে। এর মানে হল যারা কৃষি দিয়ে ভালো আয় করছে তারা কৃষিবহির্ভূত আয়ের ক্ষেত্রেও ভালো করছে। অর্থাৎ কৃষিতে দুর্বল শ্রেণীগুলো কৃষিবহির্ভূত আয়ের ক্ষেত্রে সুবিধা করে উঠতে পারছে না। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে বৈষম্য বাড়ছে এবং দারিদ্র্য নিরসনেও তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না।

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসে প্রবাসীদের রেমিটেন্স থেকে। কিন্তু প্রবাস গমনের যে ব্যয় তা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের পক্ষে সংকুলান করে ওঠা সম্ভব হয় না। ফলে সফল প্রবাসগামীরা মূলত বড় ও মাঝারি কৃষক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এরা রেমিটেন্সের টাকা দিয়ে একদিকে যেমন ভোগ ব্যয় বাড়াতে পারে, আবার অন্যদিকে এমনসব কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নিতে পারে যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এছাড়া শিল্প ও কৃষির মধ্যে বিনিময় শর্তটিও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সুবিধাজনক নয়। শিল্পজাত পণ্য এদের বেশি দামে কিনতে হয় এবং কৃষিজাত পণ্য বেচতে হয় কম দামে। কৃষকদের মধ্যে বা গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য যেভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তার জন্য অর্থনীতির এ ভারসাম্যহীনতা কোনো অংশে কম দায়ী নয়। উল্লেখ্য, উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার বিচারে কৃষিজীবীদের ৩২ শতাংশই দরিদ্র। কৃষিজীবীদের এ দারিদ্র্য দূর করতে না পারলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হবে না এবং দেশীয় শিল্পজাত পণ্যের চাহিদাও আশানুরূপ বৃদ্ধি পাবে না। সুতরাং কৃষির দুর্বলতা শিল্প খাতের দুর্বলতাকেও প্রকট করে তুলবে।

বেকারত্বের সমস্যাও আমাদের দারিদ্র্যের সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে। খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য মতে, কৃষি খাত সংশ্লিষ্টদের পর বেশি দরিদ্র রয়েছেন বেকাররা। দরিদ্রদের মধ্যে ১৪.৯ শতাংশ পরিবারপ্রধান কর্মহীন। ২০১০ সালে দরিদ্রদের মধ্যে কর্মহীন ছিল ১২.৬ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে ১৪ শতাংশ সেবা খাত সংশ্লিষ্ট, ১১.৩ শতাংশ উৎপাদন ও পরিবহন খাতের, ৮.৩ শতাংশ বিক্রয়কর্মী, ৭.৬ শতাংশ পেশাজীবী ও প্রকৌশল খাতের এবং ২.৩ শতাংশ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশে দারিদ্র্য অর্থনীতির প্রায় সব খাতকেই জড়িয়ে আছে। আয় বৃদ্ধির সুযোগ, শিল্প ও কৃষি খাতের বিনিময় শর্ত কৃষকবান্ধব করা, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা এবং নিশ্চিত ও নিয়মিত আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা ছাড়া দারিদ্র্যের প্রকোপ দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের মহাসড়কে বিচরণের জন্য সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য নিরসনই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হবে সমৃদ্ধ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা। এ পথে আমাদের যাত্রা খুবই ধীরগতিসম্পন্ন।

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

 

 

https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/11/14/171559